কিভাবে বাড়িতে ফুড হাইজিন মেইনটেইন করবেন?

ফুড হাইজিন কিংবা খাদ্যের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা একটি খুব গুরুত্বপুর্ন বিষয়। বর্তমানে আমরা প্রায় সময়ই শুনি ভোক্তা অধিকার কিংবা খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট কিংবা কমার্শিয়াল কিচেনগুলোতে অভিযান চালানো হয় এই ফুড হাইজিন নিশ্চিত করার জন্য।
Food Hygiene যে শুধুমাত্র রেস্টুরেন্ট এবং কমার্সিয়াল কিচেন এর মধ্যে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, বরং আপনার বাড়িতেও এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করাটা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ন। বাড়িতে সঠিকভাবে ফুড হাইজিন মেইনটেইন করা আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিৎ করে। কিন্তু এর জন্য আপনাকে খাদ্য অধিদপ্তরের কোন ট্রেইনিং করা লাগবে না অথবা তাদের কেউ আপনার বাসায় অভিযান চালাবে না। খুব সাধারন কিছু বিষয় নিশ্চিত করেই আপনি নিজের বাসায় এই ফুড হাইজিন নিশ্চিত করতে পারেন। আমাদের আজকের আর্টিকেলটি আপনাকে কিছু টিপস দেবে এই ফুড হাইজিন নিশ্চিত করার ব্যাপারে। চলুন জেনে নেয়া যাক।

১) রান্নাঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা:-

আপনার বাসার খাবার প্রস্তুত করার মূল কারখানা হচ্ছে আপনার রান্নাঘর। একটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর আপনার পরিবারের জন্য ফুড হাইজিনকে নিশ্চিত করে।
.কাউন্টারটপ, কাটিং বোর্ড, বাসনপত্র এবং রান্নাঘরের যন্ত্রপাতি নিয়মিত পরিষ্কার ও স্যানিটাইজ করুন।
· সিঙ্কে থালা বাসন জমিয়ে রাখবেন না।
· কাঁচা মাংস, শাকসবজি এবং ফলের জন্য পৃথক কাটিং বোর্ড ব্যবহার করুন।
· রান্নাঘরের মেঝে সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। প্রয়োজনে কাটাকাটি করার সময় পেপার বা কিছু বিছিয়ে নিন।
· সপ্তাহে প্রতিদিন অথবা ২/৩ রান্নাঘর ভালভাবে পরিষ্কার করা। ক্যাবিনেটের পিছনে, রেফ্রিজারেটরের নীচে- বিশেষত যেই জায়গাগুলোতে সহজে আপনি পৌছতে পারেননা কিন্তু এখানেই প্রচুর ময়লা এবং পোকামাকড় বাসা বাধে, সেই জায়গাগুলোকে ভালোভাবে পরিস্কার করুন।
· চুলার ওপর রান্না করার সময় পড়ে যাওয়া ঝোল ,তরকারি, তেল অত্যাদি নিয়মিত পরিস্কার করুন।

২) সঠিকভাবে হাত ধোয়া

খাবারে জীবানু অথবা ক্ষতিকর কিছু পৌছানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হলো আপনার হাত। সঠিকভাবে হাত ধোয়া ফুড হাইজিন এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাবার রান্না করার আগে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড গরম পানি এবং সাবান দিয়ে আপনার হাত ধুয়ে নিন। বাথরুম ব্যবহার করার পরে, কাঁচা মাংস, হাঁস-মুরগি, পোষা প্রাণীকে স্পর্শ করার পর এবং বাচ্চাদের ডায়াপার পরিবর্তন করার পরে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিবেন। কারন এগুলো জীবানু ছড়ায়।

৩) সঠিক খাবার নির্বাচন এবং সঠিকভাবে খাদ্য সংরক্ষন

সবসময় তাজা শাক-সবজি, মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার ক্রয় করুন। খেয়াল রাখবেন যেন বাজার করার সময় মাছ, মাংস ইত্যাদি তাজা থাকে। কারন পচা মাংস এবং মাছে অনেক ধরনের জীবানু এবং তা যদি ফরমালিন দেয়া হয় তাহলে তা বেচে থাকে অনেকদিন।

ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে খাবার নষ্ট হওয়া রক্ষা করতে কাঁচা এবং রান্না করা খাবার আলাদা করে রাখুন। সঠিক তাপমাত্রায় খাবার রান্না করলে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য রোগ জীবানু মরে যায়, তাই ভালোভাবে রান্না করে নিন। আপনার রেফ্রিজারেটর এবং ফ্রিজকে তাপমাত্রা সঠিকভাবে সেট করুন (ফ্রিজের জন্য 40°F বা 4°C এর নিচে)। এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পেতে ফ্রিজের সাথে দেয়া ক্যাটালগটি ভালোভাবে পরে নিন। সেখানে কোন ধরনের খাদ্যের জন্য কতটুকু ঠান্ডা হওয়া প্রয়োজন তা উল্লেখ করা থাকে। এছাড়াও অন্যান্য খাবার যেন দূষিত না হয়ে যায় এই জন্য কাঁচা মাংস কিংবা মাছ সর্বনিম্ন শেলফে সংরক্ষণ করুন।
আরেকটি গুরুত্বপুর্ন বিষয় হচ্ছে, আমরা অনেকেই ডিপ ফ্রিজ কিংবা নরমাল ফ্রিজেও অনেক প্যাকেট এবং খাবার গাদাগাদি করে রাখি, যা ফ্রিজের জন্য ক্ষতিকর। এতে করে ফ্রিজের ভিতরে বাতাস প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে বাতাস প্রবাহিত না হলে খাবার সঠিকভাবে ঠান্ডা হবে না এবং এতে করে পচনশীল খাদ্যগুলো খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে।

৪) সাস্থ্যসম্মতে উপায়ে খাদ্য প্রস্তুতকরণ

· আমরা অনেকেই আমাদের রান্নাঘরেন খুব সাধারন কিন্তু গুরুত্বপুর্ন একটা জিনিসের দিকে খেয়াল করি না। কাটিংবোর্ড- কাটাকাটির জন্য অত্যন্ত দরকারি একটি জিনিস। আমরা অনেকেই একই বোর্ডে সব ধরনের জিনিশ কেতে ফেলি, কিন্তু সেটি মোটেই উচিত নয়। কাঁচা মাংস, মুরগি, বা সামুদ্রিক খাবার প্রস্তুত করার সময় পৃথক কাটিং বোর্ড এবং পাত্র ব্যবহার করুন এবং ব্যবহারের পরে কাটিং বোর্ড এবং পাত্র ভালভাবে ধুয়ে ফেলুন।
· সব ধরনের খাবার একই তাপমাত্রায় রান্না হয় না। এক এক ধরনের খাবার বিভিন্ন তাপমাত্রায় ভালো সিদ্ধ হয় এবং রান্না হয়। যেমনঃ মাছ 145°F; টার্কি, মুরগি, হাঁস 165 °F; গ্রাউন্ড গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস 160°F তাপমাত্রায় ভালো রান্না হয়। রান্নার সঠিক তাপমাত্রা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে একটি ফুড থার্মোমিটার ব্যবহার করতে পারেন।
· কাঁচা বা কম সিদ্ধ ডিম খাওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ কাঁচা ডিমে অনেক ব্যাকটেরিয়া থাকে।
·তরল দুধ ২/৩ দিনের বেশি ফ্রিজে রাখবেন না।
· রান্না করা খাবার ধোঁয়া ওঠা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত খোলা রেখে দিবেন।
· রান্নায় কম পানি ব্যবহার করবেন।

৫) রান্না করা বাড়তি খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষন করুন

বাড়তি খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষন না করলে সেগুলো নষ্ট হয়ে গিয়ে অপচয়ের খাতায় চলে যায়, তাই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়াটাও খুব জরুরি। কারন সঠিকভাবে সংরক্ষন করা না হলে এই রান্না করা খাবার পচে গিয়ে অন্যান্য খাবারকেও দূষিত করে ফেলবে এবং এই খাবার খেলে পরিবারের সদস্যগনও অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
তাই সঠিক তাপমাত্রায় এদেরকে সংরক্ষন করুন। ৩-৪ দিনের বেশি ফ্রিজে রান্না করা খাবার রাখবেন না। পুনরায় গরম করে খাবার সময় এটা নিশ্চিত করবেন যেন তা ভালোভাবে গরম করা হয়।

৬) সঠিক খাদ্যবর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করতে মেয়াদোত্তীর্ণ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার দ্রুত ফেলে দিন। খাদ্য বর্জ্যের পাত্র থেকে কীটপতঙ্গ এর উদ্ভব এবং দুর্গন্ধ প্রতিরোধ করার জন্য একটি ঢাকনাযুক্ত ট্র্যাশ ক্যান ব্যবহার করুন।

৭)ফল এবং কাঁচা খাবার এর সঠিক ব্যবস্থাপনা

· ফল ও সবজি ঠাণ্ডা, প্রবাহিত পানিতে ধুয়ে ফেলুন। আলু এবং গাজরের মতো শক্ত জিনিসের জন্য স্ক্রাব ব্রাশ ব্যবহার করুন।
· মাছ-মাংস বাজার থেকে আনার ‍যত দ্রুত সম্ভব রান্না করে ফেলবেন অথবা ডিপ ফ্রিজে রেখে দিবেন।
· মেরিনেট করা মাছ মাংস মেরিনেট করার জন্য ঢেকে রাখবেন অথবা ফ্রিজে উঠিয়ে রাখবেন। খোলা ক্যাবিনেট অথবা রান্নাঘরের তাকে রেখে দেবেননা।
· রেফ্রিজারেটরে কাঁচা মাংস এবং মুরগি থেকে ফল ও শাকসবজি দূরে রাখুন। একসাথে রাখলে খাবারে জীবাণুর বিস্তার হতে পারে।
· ফল কেটে বেশিক্ষণ রেখে দেওয়া ঠিক নয়। কারন ফলের পুষ্টিগুন নষ্ট হয়ে যায়।

৮) কীটপতঙ্গ থেকে খাবারকে রক্ষা করুন:

খাদ্যের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার জন্য পোকামাকড় এবং ইঁদুরের মতো কীটপতঙ্গ থেকে আপনার রান্নাঘরকে রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন ছিদ্র বা খোলা জায়গা, যেখানে কীটপতঙ্গ প্রবেশ করতে পারে সেগুলি বন্ধ করুন। নিরাপদ রাখার জন্য বায়ুরোধী পাত্রে খাদ্য সামগ্রী সংরক্ষণ করুন। পঁচা-বাসি খাবার জমিয়ে রাখবেন না। কারন পঁচা-বাসি খাবার থেকে ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়।

৯) অ্যালার্জি কিংবা ফুড-সেন্সিটিভিটি এর ব্যাপারে সতর্ক থাকুন

আপনার পরিবারের কারো যদি খাবারে অ্যালার্জি থাকে কিংবা কোন সদস্যের যদি নির্দিষ্ট কোন খাবারের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা থাকে, তাহলে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন। অ্যালার্জেন-মুক্ত খাবারের জন্য নির্দিষ্ট পাত্র, কাটিং বোর্ড ব্যবহার করুন।

১০) নিয়মিতভাবে রান্নাঘরের সরঞ্জাম পরীক্ষা এবং পরিস্কার করুন

আপনার রান্নাঘরের সরঞ্জাম যেমন ওভেন, রেফ্রিজারেটর এবং মাইক্রোওয়েভগুলি সঠিকভাবে কাজ করছে তা নিশ্চিত করতে পরীক্ষা করুন। কারণ কোন ত্রুটি থাকলে তা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরিতে সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও এই জিনিসগুলো নিয়মিত পরিস্কার করুন যেন অহেতুক ময়লা জমে খাবারকে দূষিত করতে না পারে।
আপনার পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে ফুড হাইজিনের গুরুত্ব সম্পর্কে শেখান। সঠিকভাবে হাত ধৌত করা, সাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করুন। এছাড়াও খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করার সময় তাদের মেয়াদ উত্তীর্নের তারিখ সম্পর্কে সতর্ক থাকুন।
ফুড হাইজিন সম্পর্কে আরো জানুন
সবশেষে বলতে হয়, বাড়িতে খাদ্যের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা কেবল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয় নয়; এটি আপনার স্বাস্থ্য এবং আপনার প্রিয়জনদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। এই সাধারন নিয়মগুলি অনুসরণ করে আপনি আপনার পরিবারের জন্য খাদ্যজনিত অসুস্থতার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার নেয়া ছোট্ট একটু সতর্কতা আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনেক দূর এগিয়ে যায়।
Visit my recipe website

Leave a Reply