রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় বলতে শুনলাম,
“ভাইরে আমার তো চিকুনগুনিয়াতে ধরছে। মাত্র
টেস্টা করায় আনলাম।” তাকিয়ে দেখি এক
ব্যক্তি গাড়ি থেকে মুখ বের করে রাস্তায়
দেখা হওয়া পরিচিতকে এই কথা বলছেন।
কয়েকদিন আগেও এই রোগের নাম তেমন
প্রচলিত ছিল না।
নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ পঞ্চাশ শয্যাবিশিষ্ট
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের
পরামর্শদাতা ডা. কামরুল হাসান (বিসিএস
স্বাস্থ্য) বলেন, “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিশ্চিতভাবে সনাক্ত
করার স্থান হল রাজধানীর মহাখালিতে
অবস্থিত রোগ তত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা
ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর। এই গবেষণা
কেন্দ্রে ‘সেলোরজি’ পরীক্ষার মাধ্যমে
নিশ্চিতভাবে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস সনাক্ত
করা সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “ভাইরাসটি এডিস মশার
মাধ্যমে ছড়ায়। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত
ব্যক্তিকে কামড়ানো মশাটি সুস্থ কাউকে
কামড়ালে তার শরীরেও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ
ঘটে।”
রোগের লক্ষণ সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন,
“চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণগুলো অন্যান্য সকল
ভাইরাল জ্বরের মতোই। হাড়ের জোড়ায় তীব্র
ব্যথাই এই রোগের একমাত্র স্বতন্ত্র উপসর্গ।
সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া,
বমিভাব, শারীরিক দুর্বলতা, সর্দি-কাশি,
র্যাশ ইত্যাদি তো আছেই।”
“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে চার দিনের
মধ্যে জ্বর সেরে যায়। তবে হাড়ের জোড়ের
ব্যথা নাছোড়বান্দায় রূপ নেয়। ব্যথার
তীব্রতাও প্রচণ্ড। ফলে রোগীর স্বাভাবিক
হাঁটাচলা, হাত দিয়ে কিছু ধরা এমনকি হাত মুঠ
করতেও বেশ কষ্ট হয়। আর শরীর প্রচণ্ড দুর্বল
হয়ে পড়ে।” বললেন ডা. কামরুল।
পরামর্শ
একটানা তিন দিন জ্বর ও হাড়ের জোড়ে প্রচণ্ড
ব্যথা থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
এই রোগের বিশেষ কোনো ওষুধ বা টিকা নেই।
প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা পর কিংবা তিনবেলা
প্যারাসিটামল খেতে পারেন। তবে কোনো
ওষুধই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত
নয়।
অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে কোনো উপকার
নেই। বরং অ্যান্টিবায়োটিকের
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা তৈরি
করতে পারে।
এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার
পাশাপাশি ডাবের পানি, স্যালাইন, লেবুর
সরবত ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা
ইনস্টিটিউট (আইআডিসিআর) স্বাস্থ্য
অধিদপ্তর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ
মন্ত্রণালয়, তাদের ওয়েবসাইটে চিকুগুনিয়া
নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাস জনিত জ্বর যা
আক্রান্ত মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষ থেকে
মানুষে ছড়ায়। এ রোগ ডেঙ্গু, জিকা’র মতোই
এডিস প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়।
রোগটি প্রথম ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে দেখা
যায়। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন-
ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং
ইন্দোনেশিয়াতে এর বিস্তার দেখা যায়।
বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও
চাঁপাই নবাবগঞ্জে প্রথম এ ভাইরাসের
প্রার্দুভাব দেখা যায়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে
ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা যায়।
তবে এর পরে বিচ্ছিন্ন দুএকটি রোগী ছাড়া এ
রোগের বড় ধরনের কোনো বিস্তার আর
বাংলাদেশে লক্ষ করা যায়নি।
বর্ষার পর পর যখন মশার উপদ্রব বেশি হয় তখন এ
রোগের বিস্তার বেশি দেখা যায়।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস কী? চিকুনগুনিয়া ভাইরাস
টোগা ভাইরাস গোত্রের ভাইরাস। মশাবাহিত
হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে।
ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাস ও একই মশার মাধ্যমে
ছড়ায় এবং প্রায় একই রকম রোগের লক্ষণ দেখা
যায়।
রোগের লক্ষণ সমূহ (১) হঠাৎ জ্বর আসা সঙ্গে
প্রচণ্ড গিঁটে গিঁটে ব্যথা। অন্যান্য লক্ষণ
সমুহের মধ্যে- (২) প্রচণ্ড মাথাব্যথা (৩)
শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি (Chill) (৪) বমি বমি
ভাব অথবা বমি (৫) চামড়ায় লালচে দানা
(Skin Rash) (৬) মাংসপেশিতে ব্যথা (Muscle
Pain)
সাধারণত রোগটি এমনি এমনিই সেরে যায়,
তবে কখনও কখনও গিঁটের ব্যথা কয়েক মাস
এমনকি কয়েক বছরের বেশি সময় থাকতে
পারে।
বাহক: এডিস ইজিপ্টি ((Ades aegypti) এবং
এডিস এলবোপিকটাস (Ades albopictus) মশার
মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। মশাগুলোর শরীরের ও
পায়ের সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ দেখে
সহজেই চেনা যায়।
কারা ঝুঁকির মুখে: এ মশাগুলো সাধারণত
পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে জন্মায় এবং যাদের
আশপাশে এ রকম মশা বৃদ্ধির জায়গা আছে, সে
সব মানুষেরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
কীভাবে ছড়ায়: প্রাথমিকভাবে চিকুনগুনিয়া
ভাইরাসে আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টাই অথবা
এডিস অ্যালবুপিক্টাস মশার কামড়ের মাধ্যমে
ছড়ায়। এ ধরনের মশা সাধারণত দিনের বেলা
(ভোর বেলা অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়।
এছাড়াও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস আক্রান্ত
রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং
ল্যাবরেটরীতে নমুনা পরীক্ষার সময়ে
অসাবধানতায় এ রোগ ছড়াতে পারে।
সুপ্তিকাল: ৩-৭ দিন (তবে ২-২১ পর্যন্ত হতে
পারে)।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ : এ রোগ প্রতিরোধের
কোনো টিকা নাই। ব্যক্তিগত সচেতনতাই
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের
প্রধান উপায়।
মশার কামড় থেকে সুরক্ষা: মশার কামড় থেকে
সুরক্ষাই চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে
রাখা (ফুল হাতা শার্ট এবং ফুল প্যান্ট পরা),
জানালায় নেট লাগানো, প্রয়োজন ছাড়া
দরজা জানালা খোলা না রাখা, ঘুমানোর সময়
মশারি ব্যবহার করা, শরীরে মশা প্রতিরোধক
ক্রিম ব্যবহার করার মাধ্যমে মশার কামড়
থেকে বাঁচা যায়।
শিশু, অসুস্থ রোগী এবং বয়স্কদের প্রতি
বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
মশার জন্মস্থান ধ্বংস করা: আবাসস্থল ও এর
আশপাশে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে
হবে। বাসার আশপাশে ফেলে রাখা মাটির
পাত্র, কলসী, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোলা
ইত্যাদি যেসব জায়গায় পানি জমতে পারে,
সেখানে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে। এসব
স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সে
ব্যাপারে লক্ষ রাখা এবং নিয়মিত বাড়ির
আশপাশে পরিষ্কার করা। সরকারের মশা নিধন
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা।
যেহেতু এ মশা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত থেকে
জীবাণু নিয়ে অন্য মানুষকে আক্রান্ত করে,
কাজেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে যাতে মশা
কামড়াতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা
নেওয়া।
রোগ নির্ণয়: উপরোল্লিখিত উপসর্গগুলো দেখা
দিলে, ওই ব্যক্তির চিকুনগুনিয়া ভাইরাস
সংক্রমণের আশংকা থাকে। উপসর্গগুলো শুরুর
এক সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত
ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি (Serology Ges এবং
RT-PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ
নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট
(আইইডিসিআর)-এ চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের
সকল পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা: চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের
চিকিৎসা মূলত উপসর্গ ভিত্তিক। এর কোনো
সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে
বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরলজাতীয়
খাবার খেতে হবে এবং প্রয়োজনে জ্বর ও
ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এবং
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ওষুধ খেতে
হবে।
গিটের ব্যথার জন্য গিঁটের উপরে ঠাণ্ডা
পানির স্যাঁক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী
হতে পারে। তবে প্রাথমিক উপসর্গ ভালো
হওয়ার পর যদি গিঁটের ব্যথা ভালো না হয়,
তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ
খেতে হবে। কোনো কারণে রোগীর অবস্থা
অবনতি হলে দ্রুত নিকটস্থ সরকারী
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
[সংগৃহীত]
11 thoughts on "চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ"