৫০টি প্রকল্প। সব কটি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তৈরি। বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোতে তরুণদের উদ্ভাবনী প্রকল্প প্রদর্শনের জন্য ছিল ‘ইনোভেশন জোন’। তরুণেরা সেখানে দেখিয়েছেন তাঁদের প্রযুক্তি–উদ্ভাবন। সেগুলোর কয়েকটি নিয়ে এ আয়োজন
গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করার একটাই কারণ—নতুন কোনো উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে প্রযুক্তিতে এগিয়ে নেওয়া। তবে স্বাভাবিকভাবেই সব দেশের সে সামর্থ্য থাকে না। আপাতদৃষ্টিতে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ার এটাই কারণ মনে হতে পারে। তবে অ্যাপল সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর মতে, উদ্ভাবনের সঙ্গে খরচ করা অর্থের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা বরং নেতৃত্ব, জনবল এবং কীভাবে কাজটা করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে। হয়তো সে লক্ষ্য নিয়েই দেশে হার্ডওয়্যার পণ্যের প্রদর্শনী বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোতে তরুণ উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনী প্রকল্প প্রদর্শন করা হয়েছিল ‘ইনোভেশন জোন’–এ।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান ছিলেন ইনোভেশন জোনের আয়োজক। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আইসিটি বিভাগের উদ্ভাবনী তহবিল থেকে সম্ভাবনাময় প্রকল্পগুলোর জন্য ২৫ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত তহবিল দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়নের জন্য সেটা কাজে লাগানো যায়। দ্বিতীয়ত, দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া, যাতে হার্ডওয়্যার নির্মাণে
আমরা সক্ষমতা অর্জন করতে পারি। ইনোভেশন জোনে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না।’
ইনোভেশন জোনে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০টি প্রকল্প স্থান পেয়েছিল। ৪ মার্চ সন্ধ্যায় ইনোভেশন জোন ঘুরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকল্প নিয়ে এই লেখা।
লাল নীল বাতি জ্বেলে হাত-পা ছুড়ে কিছুক্ষণ তার হিপহপ নাচ চলল। এরপর করমর্দন করে জানাল যে তার নাম রিবো। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণের তৈরি রিবো নামের এই রোবটটি ইনোভেশন জোনে ঢুকতেই প্রথম চোখে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের (সিএসই) অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটির অর্থায়নে তৈরি এই রোবটটিকে বাংলায় প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয় বাংলাতেই। মেলায় কথা হয় প্রকল্পটির সদস্য নওশাদ সজীবের সঙ্গে। তিনি জানান, রিবো এখন বাংলায় ১০টি নিদের্শ বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী উত্তর দিতে বা কাজ করতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের প্রকল্পটিকে আরও এগিয়ে নিতে।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি—বাংলাদেশের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজ নাগিব রেললাইনের জন্য রোবট তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, রোবটটি আলট্রাসনিক শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে রেললাইনে কোনো ভাঙন আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখে তথ্য পাঠাবে কম্পিউটার সার্ভারে। সার্ভার কম্পিউটার থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেলে উদ্ধার বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছেন কৃত্রিম উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) থেকে তথ্য সংগ্রহের গ্রাহক যন্ত্র। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যখন নির্দিষ্ট স্যাটেলাইটটি প্রদক্ষিণ করবে অর্থাৎ সবচেয়ে কাছের অবস্থানে যখন থাকবে, তখন তা থেকে এই গ্রাহক যন্ত্র দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আবহাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাষ দেওয়া সম্ভব হবে। এর সঙ্গে আছে ড্রোন। গ্রাহক যন্ত্রের সঙ্গে ড্রোনের সম্পর্ক কী, তা নিয়ে জানালেন প্রকল্পটির এক
সদস্য বিজয় তালুকদার। বললেন, ‘আমরা হয়তো কোনো ঝড়ের পূর্বাভাষ পেলাম, কিন্তু সে সম্পর্কে তো সবগুলো অঞ্চলে জানাতে হবে। ড্রোন সে কাজটি করতে পারবে।’
নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের তিন শিক্ষার্থী তৈরি করেছেন স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থা। প্রকল্পের সদস্য তৌসিফ ওসমান বলেন, ‘আমরা প্রথমে ক্যামেরার মাধ্যমে যানবাহনের চাপ নির্ণয় করে কোন রাস্তায় কতটুকু সময়ের জন্য যানবাহন সরবরাহ করতে হবে, তা ঠিক করব। এরপর চাপ অনুযায়ী ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করলে যানজট সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দল তৈরি করেছেন সাশ্রয়ী মেরিন ব্ল্যাক বক্স। ব্ল্যাক বক্সের দাম সাধারণত লাখ টাকার বেশি হয়। তবে তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় তা তৈরি করা সম্ভব হবে। দুর্ঘটনাকবলিত
জাহাজ থেকে এই ব্ল্যাক বক্সের মাধ্যমে তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র সেলিম রেজা তৈরি করেছেন আগুন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। তার গবেষণাপত্রের অংশ হিসেবে এই কাজটি করেন। জানালেন, কোথাও আগুন ধরলে সঙ্গে সঙ্গে সেন্সরে বিষয়টি ধরা পড়বে। এরপর সার্ভার কম্পিউটারে তা জানালে প্রথমে এসএমএসের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে এবং অপেক্ষা না করে যেখানে আগুন ধরেছে, সেখানে আগুন নেভানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাসায়নিক উপাদান স্প্রে করা হবে।
মেলার শেষ দিন ৫ মার্চ সেরা সেরা প্রকল্পগুলোকে পুরস্কৃত করা হয়। সেরাদের সেরা হয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রকল্প মেরিন ব্ল্যাক বক্স। তিনটি বিভাগে নয়টি প্রকল্প পুরস্কার পেয়েছে।
বিজয়ী প্রকল্পগুলো
সেরাদের সেরা: মেরিন ব্ল্যাক বক্স (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি)
বিভাগ: স্মার্ট এবং এমবেডেড সিস্টেম
প্রথম: মেরিন ব্ল্যাক বক্স (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি)
দ্বিতীয়: ইন্টারনেট হোম অটোমেশন অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম (আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)
তৃতীয়: স্মার্ট ইরিগেশন অ্যান্ড ফার্টিলাইজেশন (সিটি ইউনিভার্সিটি)
বিভাগ: রোবটিকস
প্রথম: স্বর-যান—আ ভয়েস কনট্রোলড ডিসট্যান্ট মোশন (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)
দ্বিতীয়: অ্যান অটোনোমাস রোবটিক সিস্টেম টু মেনটেইন ফ্রি ফ্লোয়িং ড্রেইনস (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি)
তৃতীয়: অটোনোমাস ক্র্যাক ডিটেক্টর রোবট ফর রেইলওয়ে ট্র্যাক—স্ক্যানবট (আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি – বাংলাদেশ)
বিভাগ: কন্ট্রোল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস
প্রথম: পাওয়ার ডিসি মোটরবাইক (সিটি ইউনিভার্সিটি)
দ্বিতীয়: পিএলসি বেজড স্মার্ট অটোমেটিক কার পার্কিং সিস্টেম (ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম)
তৃতীয়: সেচ-বন্ধু (ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি)

Leave a Reply