ভারতে বায়োমেট্রিক ডাটাসহ সচিত্র পরিচয়পত্র চালু করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিতর্কিত একটি বিল যাকে আধার কার্ড বিল বলা হচ্ছে বুধবার তা রাজ্যসভায় পেশ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতে ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্টদের একটা বড় অংশ এই পদক্ষেপকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য একটি বড় বিপদ বলে মনে করছেন। ইতোমধ্যে প্রতিবেশী বাংলাদেশেও সিমকার্ড নিবন্ধনের জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু হয়েছে। বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

বিবিসি বলছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের নিম নিবন্ধনের জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা নিয়ে যখন তুমুল হইচই চলছে, ঠিক সে সময়েই ভারতে ‘আধার’ নামে জাতীয় একটি পরিচয়পত্র চালু করার জন্যও সরকার ঠিক একই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। ভারতের দ্য সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এটাও বলা হচ্ছে যে এই আধার কার্ড বিল নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপেরই সামিল। কিন্তু বায়োমেট্রিক ডেটা নিয়ে আপত্তির কারণটা কী আর তার বিরুদ্ধে সরকারই বা কী যুক্তি দিচ্ছে?

বুধবার পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় যে আধার কার্ড বিলটি পেশ করা হল, তা ইতিমধ্যেই বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েছে। এমপি আসাদুদ্দিন ওয়াইসি যেমন বলছেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তার নামে সরকার এই বিলের অপব্যবহার করতে পারে। আধার কার্ডের জন্য সংগৃহীত বায়োমেট্রিক তথ্য অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারে। বলা হচ্ছে থানায় গিয়ে এফআইআর করা থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, সব কাজেই এই কার্ড লাগবে। সেই জন্যই আমি মনে করি এই বিল ভারতে একটি পুলিশ-রাষ্ট্রের জন্ম দিতে যাচ্ছে।’

ভারতে সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটি বা সিআইএস এবং ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটির বহু গবেষকও এক যৌথ বিবৃতিতে এই বিলের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। কেন তারা এই পদক্ষেপকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করছেন, তা ব্যাখ্যা করে সিআইএসের গবেষণা প্রধান সুমন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিবিসিকে বলছিলেন আঙুলের ছাপ, চোখের স্ক্যান বা ডিএনএ-র মতো বায়োমেট্রিক ডেটা যদি একবার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য কারও হাতে পড়ে তাহলে ‘আমি যে আসলে আমিই’ তা প্রমাণ করার কোনও উপায় থাকে না।

তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশে মোবাইল কোম্পানিগুলো বা ভারতে সরকার নিজে যে বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করছে তা কতটা সুরক্ষিত, কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা কারোরই নেই। কিন্তু ভারতে সরকার এই বিলটি নিয়ে এতটাই অনড় যে এটিকে অর্থ বিলের আকারে পেশ করা হয়েছে। যাতে এতে কোনও পরিবর্তন না আনা যায়। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি যুক্তি দিচ্ছেন সরকারি রাজস্বের ন্যায্য পাওনাটা যাতে নাগরিকদের কাছে পৌঁছায় সেই জন্যই আধার কার্ডের অবতারণা। এই তথ্য সংগ্রহের আর অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই।

এটা ঠিকই যে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি পাওয়া, একশো দিনের কাজের মজুরি পাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধার কার্ড থাকলে অনেক সুবিধা হয়। এবং ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আইডেন্টিটি ফ্রড বা পরিচিতি চুরি হওয়া সম্বন্ধে মানুষের ধারণাই কম, সেখানে এটা তেমন প্রতিরোধের মুখেও পড়ছে না। তবে সুমন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলছেন তাতে বিপদটা কিন্তু কমে যাচ্ছে না। তিনি বলছেন, ‘এই বায়োমেট্রিক ডেটাকে সরকার ব্যবহার করছে একটা পাসওয়ার্ডের মতো। কিন্তু মুশকিল হল, বাস্তব জীবনে পাসওয়ার্ড বদলানোর সুযোগ আছে। কিন্তু এই বায়োমেট্রিক পাসওয়ার্ড একবার খোয়া গেলে তা বদলে নেওয়ার আর কোনও সুযোগ নেই!’

মানুষ সরকারি ভর্তুকির আশায় আধার কার্ডের বুথে গিয়ে লাইন দিলেও তারা কিন্তু সম্পূর্ণ না জেনে বুঝেই নিজেদের বায়োমেট্রিক ডেটা সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছেন, মনে করছেন মি চট্টোপাধ্যায়। ফলে এই অ্যাক্টিভিস্টরা মনে করছেন ভারত ও বাংলাদেশ, দুটো দেশেই নাগরিকরা তাদের মৌলিক পরিষেবাগুলো পাওয়ার জন্য নিজেদের এমন কিছু গোপন তথ্য সরকারের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন যার গুরুত্ব সম্বন্ধে তাদের ভাল ধারণা পর্যন্ত নেই। তবে উল্টোদিকে দুদেশের সরকারই বলছে, পরিষেবা যাতে সঠিক লোকের হাতে পৌঁছয় তাতে এই পদ্ধতি অপরিহার্য।

Leave a Reply