খুব গরমে দেশ-বাসীর অবস্থা যখল
একেবারেই নাকাল তখন ঢাক-ঢোল
পিটিয়ে অনেকটা জানান দিয়েই কাল-
বৈশাখী ঝড়ের মতোই হানা দিল
অস্তিত্ব। কাল বোশেখী কেন
বললাম? বেশ কিছু দিন ধরেই কেমন
ধীর লয়ে হাঁটছিল সিনেমা হল গুলো।
সেই একই প্রেম কাহিনী আর ফাইটিং
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, বাংলা সিনেমায় নতুন
বলতে এইগুলোই। কিন্তু অনন্য
মামুনের অস্তিত্ব এই সাধারণ গতির বাইরে,
যারা বাংলা ছবি নিয়ে নাক শিঁটকোয় তাদের
মুখে অনেক কথাই শোনা গেছে-কৃষ
ছবির নকল পোস্টার আর বরফী ছবির
নকল অভিনয়। তাদের উদ্দেশ্যে
কেবল একটা কথাই বলি-পৃথিবীর সব
মা্যের অনুভূতিই এক, কেবল
সম্বোধনটাই ভিন্ন। কেউ বলে -মা,
কেউ বা মাম্মি, কেউ বলে – আম্মিজান।
তাহলে একজন বিশেষ শিশু তার জন্ম যে
দেশেই হোক না কেন তাদের স্বভাব
কি আলাদা হবে? তা যতোই নাক
শিঁটকোক, অস্তিত্ব কিন্তু হাউজ ফুল। এই
হাউজ ফুলের জন্য অস্তিত্ব টিম কিন্তু কম
কষ্ট করেনি, পুরো আস্ত একটা সিনেমা
বানিয়ে খান্ত থাকেনি, সেই ডিসেম্বর
থেকেই মিডিয়া পাড়া-শপিং পাড়ায় ঘুরছে। বলা
বাহুল্য, অস্তিত্ব টিম আসলেই বাংলা
সিনেমার অস্তিত্বর জন্যেই লড়েছে
এবং তারা সফল। শৃমঙ্গলের নয়নাভিরাম
চায়ের বাগানের মধ্য দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে
পরী (তিশা)। পিছে পিছে হাপিয়ে
উঠছে তার ছোট ভাই, এখানে একটু
লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে
বিশেষ শিশুদের কিছু আলাদা গুণ থাকে।
এতো দৌঁড়েও পরি কিন্তু হাঁপায়নি, সে ঠিকি
ঢুকে গেছে এক অপরিচিত বাড়িতে।
বাড়ির ভেতর মিউজিক ছেড়ে নাচানাচি
করছিল সেই বাড়ির কন্যা। হঠাৎ করেই
আবির্ভাব ঘটে তার বাবার। এই চারটি চরিত্র
যখন এক হয় তখনই দর্শক সহজে বুঝে
যাবে-তিশার অভিনয়ের কি দক্ষতা। একজন
অভিনেত্রী তার অভিনয় দিয়ে কিভাবে
একটি চরিত্রে বসবাস করতে পারে।
সে একাই পুরো দৃশ্যকে টেনে
নিয়ে গেছে তাও কোন সংলাপ ছাড়াই।
কেবল এই অব্দি নয়, ছোট ভাইয়ের
বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবার যে গান
দর্শককে ক্লান্ত করে দিতে পারতো
তার দায়টুকুই তিশা একাই বহন করেছে।
হ্যাঁ, তিশা দূর্দান্ত ভাবে পরি চরিত্রকে
ফুটিয়ে তুলেছে, তার আশেপাশে
যতো আনাড়ি অভিনেতা ছিল তা্রা এই
ফাঁকে বলা চলে উতড়ে গেছে।
“হাঙ্গর নদী গ্রেনেড” যারা
দেখেছেন তাদের আর নতুন করে
সুচরিতার কথা না বললেও চলবে। একজন
বিশেষ শিশু, মূলত সে যদি হয় কন্যা
তাহলে মায়ের মনে কি ধরণের দুঃচিন্তা
হয়, তা প্রতি পদে পদে নিঁখুত অভিনয়
গুণে বুঝিয়ে দিয়েছেন সুচরিতা।
পরীকে যখন বিশেষ স্কুলে রেখে
আসা হয় তখন তিশা আর সুচরিতার মাঝের
সম্পর্কের যে অনবদ্য চিত্র পরিচালক
তুলে ধরেছেন তার জন্য সশ্রদ্ধ
ভালোবাসা অপরিসীম, কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড
মিউজিকের মাধ্যমে তা দিয়ে দর্শকের
চোখে পানি ঝরানো সহজ কাজ না।
আরেফিন শুভ অর্থাৎ বিশেষ স্কুলের
শিক্ষক ইন্তু নিজের মুখেই মেরিল
প্রথম আলোতে বলেছে – আগে
ছিলাম রাস্তার ছেলে শুভ, দর্শক আমাকে
আরেফিন শুভ বানিয়েছে। আমার কথা
সোজা-যার যোগ্যতা আছে তাকেই
দর্শক তার হৃদয় মন্দিরে জায়গা দেয়।
আরেফিন শুভ ইন্তু চরিত্রে শতভাগ
সফল।বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে তার
উল্টো হয়ে পড়ে যাওয়া এবং হুইল
চেয়ারে বসা অবস্থায় চোখ দিয়ে পানি
গড়িয়ে পড়ার মুহূর্ত অনেককাল মনে
রাখবে এই দেশের ইমোশনাল জাতি।
সিনেমাটিতে আরো যারা অভিনয়
করছেন -সুব্রত, সুজাতা আজিম, ডন, কাবিলা,
নিঝুম রাবিনাসহ আরো অনেকে।
ছবিটিতে সব চেয়ে আকর্ষনীয় ছিল
লোকেশন। বিশেষ করে শৃমঙ্গলের
চা বাগান আর কক্সবাজারের বীচ, তাছাড়াও
শ্যুটিং হয়েছে ঢাকা এবং ভোলাতে।
কস্টিউমের কথা যদি বলতেই হয়, আমার
মনে হয় নারী চরিত্রকে শালীনতার
মধ্যে রেখেও যে ছবি হিট করানো
যায় তা প্রমাণ করে দিলেন অনন্য মামুন।
বিশ বছরের তরুনী (অটিস্টিক) চরিত্র
করতে গিয়ে অনেক বার ছোট ফ্রক
পড়তে হয়েছে তিশাকে, কিন্তু কোন
অবস্থাতেই তাকে ভাল্গার লাগেনি। এমন
কি ট্রেলার (?)গান – আমি বাংলার
হিরোতেও তিশার পোশাক ছিল
সাবলীল। অস্তিত্ব ছবির গান ছিল
সর্বসাকূল্যে চারটি। তার মধ্যে পরিচালক
যে গানটিকে প্রিয় হিসেবে উল্লেখ
করেছেন তা হলো-“আর নয় ভাবনা, এ
প্রেমের ঠিকানা।।তোর নামে লিখেছি
হৃদয়।” পুরো গানটি একটি স্টেজের
উপর চিত্রায়ন করা হয়েছে তাতে
জমকালো রঙের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু
যারা আমার মতোন প্রকৃতিপ্রেমী তারা
নিশ্চই এই গানটি পছন্দ করবেন -“আয়না
বলনা, এই মন তোর প্রেমে
ডুবেছে”। তবে, এই গানটি খুব হঠাৎ
করেই যেন আরম্ভ হয়ে যায় যখন
ইন্তু পরীর ছবি আঁকার খাতা দেখছিল।
পরিচালক বিশ বছরের পরীর মস্তিষ্কে
কখন প্রেম বিষয়টা ঢুকিয়ে দিয়েছেন
তা দর্শক বুঝে ওঠার আগেই তা
চোখের সামনে আরম্ভ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে অবশ্য বেশ কয়েকটি
দৃশ্যের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া
হয়েছে যে পরী ইন্তুকে
ভালোবাসে। তাহলে এই গানটি আরো
পরে আসা উচিত ছিল। আর সবচাইতে
বেশি চোখে লেগেছে ডন যখন
টেলিভিশনে কোন গান দেখতে
চাইছে তখন শুভ আর তিশার -আমি বাংলার
হিরো গানটি হচ্ছিল। গানের
কোরিওগ্রাফি, নৃত্য নির্দেশনা, চিত্রগ্রহণ
নিঃসন্দেহে চমৎকার। কিন্তু এই ধরণের
গান সাধারণত ট্রেলারে বা ছবির শেষে
দেওয়া যায়।এমন একটি সিরিয়াস মুডের
মধ্যে কিভাবে পরিচালক কেবল বাণিজ্যিক
চিন্তা থেকে গানটি জুরে দিলেন তা
সত্যিই বিস্ময়কর। সব ভালো কিন্তু সব
জায়গায় ভালো নাও হতে পারে।
বকুল, জাহিদ আকবর, মেহেদী হাসান
লিমন, আরজিন কামাল ও প্রিয় চট্টোপাধ্যায়।
সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ইবরার টিপু,
প্রিতম হাসান, নাহিদ ও আকাশ।
গানগুলোতে কন্ঠ দিয়েছেন ইবরার
টিপু, দিনাত জাহান মুন্নি, প্রীতম, লেমিসসহ
আরো অনেকে। কার্লোস
সালেহের গল্পে ‘অস্তিত্ব’ সিনেমার
চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন অনন্য
মামুন, কার্লোস সালেহ ও সোমেশ্বর
অলি। এই সিনেমার শ্যুটিং শুরু হয় গেল
বছর সেপ্টেম্বরে আর রিলিজ হলো
৬ মে ২০১৬। কার্লোস সালেহ নিজেই
প্রযোজনা করেছেন। পরিচালকের
সব চাইতে চোখে পড়ার মতোন
দক্ষতা ছিল, সত্যিকার বিশেষ শিশুদের
দিয়ে অভিনয় করানো। মাঝে মাঝে
দর্শক হিসেবে তালগোল পাকিয়ে
যাচ্ছিল-কে আসলেই বিশেষ শিশু!
সিনেমার প্রত্যেকটি সংলাপ ছিল দৃশ্যের
সাথে মানানসই,অতিরঞ্জিত কিছু মনে
হয়নি। স্কুল শিক্ষক ইন্তুর মুখে উচ্চারিত
কথাটি অনেক দিন মনে থাকবে-“আমি
শিক্ষক,সভ্যতার জন্য মেরুদন্ড গড়ি আর
অসভ্যদের মেরুদন্ড ভাঙ্গি।“ চমৎকার
একশন দৃশ্যের সাথে শক্ত সংলাপ গুলো
দর্শকদের এঁকঘেয়ে লাগেনি তা বলা
যায় নিশ্চিন্তে।
বিশেষ শিশুদের নিয়ে অলিম্পিকে
অংশগ্রহণ করাই ছিল ইন্তুর চ্যালেঞ্জ।
তাই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সে
শেষ অব্দি তার লক্ষে পৌঁছতে
পেরেছিল।কাহিনী চলছিল স্বাভাবিক
গতিতে,কিন্তু হঠাত ডন পরিকে তুলে
নিয়ে যায় এবং দাড়োয়ানকে মেড়ে
ফেলে। সাধারন ভাবেই ইন্তু পরীকে
সেখান থেকে রক্ষা করে, দু’জন
বিশেষ ভঙ্গিমায় স্কুলে প্রবেশ
করতে থাকে। অসঙ্গতিটা ধরা পড়ে
গেল তখন,সেখানে আর একজন
দাড়োয়ানকে দেখা গেল ক্যামেরায়।
কিছুক্ষন আগেও যেখানে একটা লাশ
ছিল সেখানে আস্ত একটা মানুষ কে কি
অর্থে বসালেন পরিচালক, প্রশ্নটা
মনের মধ্যে রেখেই এগিয়ে গেল
কাহিনী। অস্তিত্ব সিনেমার মধ্যে একটা
ম্যাসেজ ছিল পরিস্কার – বিশেষ শিশুরা
সমাজে বেশীরভাগ সময়ই হয়
অবহেলিত। এদের একটু যত্ন নিলে,
এদের বিশেষ গুনাবলির চর্চা হলে এরাই
সমাজে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ
রাখতে পারবে। এই যুগোপযোগি
ম্যাসেজটি প্রত্যেকটি ঘরে পৌঁছে যাক,
বিশেষ শিশুরা সত্যিকার অর্থেই হয়ে
উঠুক বিশেষ একটি শিশু।`অস্তিত্ব`ঢাকাই
চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ঘরানার ছবিতে
নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করলো ।
5 thoughts on "বাংলা ছবির ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ঃ অস্তিত"