আমার বন্ধু রানা সেদিন আচমকা ফোন করে বলল, ‘দোস্ত, আমার দিন শেষ! তোরা আমাকে মাফ করে দিস। আর তোর কাছে যে ৫ হাজার ৩০০ টাকা পাই, সেটা ফেরত দিতে হবে না।’ আমি চমকে উঠলাম, ‘মানে?’ : মানে আমার ফোনে কে জানি হুমকি দিয়ে এসএমএস দিয়েছে: আজকে বেঁচে গেলি। পরের বার আর বাঁচতে পারবি না, শয়তান! রানার কথা শুনে মাথা ভোঁ করে চক্কর মারল, ‘সর্বনাশ! কী বলিস এই সব! তোকে আবার কে হুমকি দিল? আচ্ছা, এক কাজ কর, তুই আমার বাসায় চলে আয়। তারপর দেখি কী করা যায়।’ ফোন রেখে আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। রানা ছেলেটা একেবারেই নিরীহ টাইপের। কারও সাতে-পাঁচে কিংবা সেলফিতেও নেই। শুধু একটু কিপটা স্বভাবের। কিন্তু সে জন্য তো কারও হুমকি দেওয়ার কথা নয়। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে রানা বাসায় এসে হাজির। দুশ্চিন্তায় মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে। হাতের শপিং ব্যাগে কাফনের কাপড়। আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘অরিজিনাল কাপড় কিনে এনেছি। ১০০ পারসেন্ট সুতি।
দাম একটু বেশিই নিল। তুই তো জানিস, আমি গরম সহ্য করতে পারি না!’ বলতে বলতে ওর কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। ভাঙা গলায় বলল, ‘বাসার সবাইকে ডাক, বিদায় নিয়ে নিই।’ আমি তাড়াতাড়ি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘এত ভেঙে পড়ছিস কেন! আমি তো আছি। তোর সব ব্যবস্থা আমি করব।’ রানা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিসের ব্যবস্থা? আমার দাফন-কাফনের?’ : আরে না না, কী যে বলিস না! তুই ফোনটা দে তো।’ আমি রানার ফোনে এসএমএসটা দেখলাম। যে নম্বর থেকে এসএমএস এসেছে, সেটা বিদেশি। রানাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘চিন্তা করিস না। চল, থানায় গিয়ে জিডি করে আসি।’ রানা থানায় যেতেও ভয় পাচ্ছিল, তবু জোর করে নিয়ে গেলাম। থানায় গিয়ে দেখলাম, ওসি সাহেবের খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। তিনি স্মার্টফোনে গেম খেলছেন। আমি কথা বলতে যেতেই পাশ থেকে এক পুলিশ বাধা দিয়ে বলল, ‘একটু অয়েট করেন। আইজকা স্যার টার্গেট নিয়া বসছেন। ১০ লাখ স্কোর না করা পর্যন্ত কথা বলবেন না।’ ফলে আমরা ‘অয়েট’ করতে লাগলাম। কিন্তু ওসি সাহেবের গেম খেলা আর শেষ হয় না।
ঘণ্টা খানেক পর তিনি আমাদের দয়া করলেন। স্মার্টফোন হাত থেকে নামিয়ে বিরক্ত গলায় জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে?’ আমি রানাকে দেখিয়ে বললাম, ‘আমার বন্ধুকে কে যেন হুমকি দিয়ে এসএমএস পাঠিয়েছে।’ : ও, তো আমরা কী করব? আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, ‘অ্যাঁ?’ ওসি সাহেব বিশাল হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘আপনের বন্ধু হুমকি খাইছে, আমরা কী করব?’ ওসি সাহেবের কথা শুনে রানা খেপে গিয়ে বলল, ‘আপনারা কী করবেন মানে! তাহলে এখানে বসে আছেন কেন?’ ওসি সাহেব আরেকটা হাই তুলে বললেন, ‘বসে থাকব না তো হাডুডু খেলব?’ রানা আরও রেগে ওঠার আগে আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ওসি সাহেব আরেক দফা গেম খেলতে শুরু করার আগে দয়া করে জানতে চাইলেন, ‘আপনে কি কোনো বিজনেস করেন? পার্টনার আছে?’ আমি রানার হয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, ‘না না, স্যার। আমার বন্ধু ব্যবসার “ব”-ও বোঝে না! ব্যবসা করবে কীভাবে?’ রানা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাল। আমি ওর হাত চেপে শান্ত থাকতে ইশারা করলাম। ওসি সাহেব বললেন, ‘কালকে আসেন। আজকে বিজি আছি। দেখি কালকে কী করা যায়।’ আমি রানার হাত ধরে বাইরে বের করে আনলাম। বাইরে এসে রানা আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকাল।
তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘চল, খাইখাই হোটেলে গিয়ে কাচ্চি খেয়ে আসি। মরে গেলে টাকাপয়সা দিয়ে আর কী হবে।’ আমিও দার্শনিকের মতো উদাস গলায় বললাম, ‘ঠিক। মৃত্যুর পূর্বে কাচ্চি খাওয়া উত্তম।’ আমরা খাইখাই হোটেলের দিকে পা বাড়াতেই রানার ফোন বেজে উঠল। সিনথিয়া, মানে রানার গার্লফ্রেন্ড ফোন করেছে। আমি বললাম, ‘বি নর্মাল। ফোন ধর।’ রানা শুকনো মুখে ফোন রিসিভ করল। আমি তখন ভাবছি ঢাকার ভালো ভালো রেস্টুরেন্টগুলোর লিস্ট তৈরি করতে হবে। বন্ধু হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে, বেচারা যাতে শেষ কটা দিন ভালোমন্দ খেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারে। হঠাৎ দেখি রানা কথা বলতে বলতে আমার হাত খামচে ধরেছে। ওর চোখে- মুখে উত্তেজনা। ফোন রেখে সে আমাকে জাপ্টে ধরল। অতিকষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘ঘটনা কী?’ রানা বলল, ‘বাঁইচা গেছি, দোস্ত! আসলে ফোনে ওই এসএমএসটা সিনথিয়ার। দুষ্টামি করে ফোন থেকে না পাঠায়া নেট থেকে পাঠাইছিল।’ আমি প্রথমে ভীষণ বিরক্তি বোধ করলাম। সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ও কিনা মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে পড়ছিল! রেগেমেগে কয়েকটা গালি ঝেড়ে দিলাম। একসময় রাগ নেমে গেল। স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘এত ভোগান্তি পোহাতে হলো, এবার খাওয়া। আজকে দুই প্লেট কাচ্চি খাব।’ রানা একটু আমতা-আমতা করে বলে, ‘ইয়ে, দোস্ত, এমনিতেই কাফনের কাপড় কিনতে গিয়ে এক্সট্রা খরচ হয়ে গেছে। তোকে আরেক দিন খাওয়াব। আর তোর কাছে যে ৫ হাজার ৩০০ টাকা পাই, সেটা ট্রাই করিস এই মাসে ফেরত দিতে।’ আমাকে সেখানেই রেখে রানা কেটে পড়ল। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে তখন গান বাজছে, ‘আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল,/ আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই…
5 thoughts on "সয়তান আজকে বেঁচে গেলি। পরের বার আর বাঁচতে পারবি না!"