রাজশাহী শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট পৌরসভা। সেখান থেকে ধানের মাঠের বুক চিরে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার রাস্তা গিয়ে ঠেকেছে পানিহার গ্রামে। আধুনিকতা আর উন্নয়নের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি এখানে। উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগলেও ৭০ বছরের পুরোনো একটি লাইব্রেরি রয়েছে এই গ্রামে। আর সে কারণেই এখানে অনেক কবি-সাহিত্যিক আসেন।
তবে লাইব্রেরিটির এখন বেহাল দশা। কাঠের আলমারিগুলো ঘুণে ভেঙে যাচ্ছে। বইগুলো অরক্ষিত পড়ে আছে। মেলেনা কোনো অনুদান। অমূল্য বইগুলো রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে পরিবারের লোকজন।
১৯৪৫ সালে স্থাপিত এই পানিহার লাইব্রেরি। গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো ছড়াতেই এনাতুল্লা মাস্টার নামে এক ব্যক্তি বাড়ির পাশে দুই শতক জমির উপর মাটির তৈরি টিন সেডের ঘরে লাইব্রেরিটি গড়ে তোলেন।
দুইটি ঘরে একটি কাঠের তৈরি আলমারিতে ১০০টি বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস সংগ্রহের মধ্য দিয়ে পানিহার লাইব্রেরির যাত্রা শুরু। বর্তমানে লাইব্রেরিতে দেশি-বিদেশি লেখকের উপন্যাস রয়েছে ৭ হাজার ৩১৫টি। এই লাইব্রেরিতে বই সংগ্রহে এসেছেন কবি, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ দেশের সব চাইতে বড় বড় বিদ্যাপিঠের শিক্ষকেরা।
প্রতিষ্ঠাতা এনাতুল্লার ছোট ছেলে মুন্জুর রহমান জানান, গ্রামের লোকের কাছে বাবা এনাতুল্লাহের পরিচিতি ‘এনায়েত পন্ডিত’। কারণটাও স্পষ্ট। তিনিই প্রথম শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
তিনি আরো জানান, তার দাদা ছিলেন কৃষক। লেখাপড়া না জানলেও তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন। আর এ কারণে তার বাবাকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর হাইস্কুলে। বাংলা ১৩১৮ সালে ওই স্কুল থেকে পাশ করেন। তারপর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ওই সময়েই তিনি নবাব বাহাদুর হাইস্কুলের লাইব্রেরির সদস্য ছিলেন। ওই লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন তিনি। পরে গ্রামে ফিরলেও বইয়ের মায়া ছাড়তে পারেন নি। আর এ কারণেই নিজের গ্রামে একটা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছিলেন এনাতুল্লাহ।
বাবার মুখে শোনা গল্পগুলো স্মৃতিচারণ করে মুনজুর রহমান জানান, তার বাবা গ্রামে ফিরে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকার গ্রাম, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্র সংগ্রহ করেন। কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে মাসিক ১৫ টাকা বেতনে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই স্কুলের ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য বই আনা হতো কোলকাতা থেকে। এই বই কিনে পাওয়া কমিশন দিয়ে আরো বই আনা হতো লাইব্রেরির জন্য। তখনও লাইব্রেরির জন্য কোনো ভবন ছিল না। একটা, দুটো করে কেনা বইয়ের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়লো। এই বই দিয়েই তিনি ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পানিহার লাইব্রেরি। লাইব্রেরির বই কেনার জন্য এনাতুল্লাহ হাত বাড়ালেন গ্রামের মানুষের কাছে। পাওয়া টাকায় আস্তে আস্তে বাড়ে বইয়ের সংখ্যা। এসময় নিজের বাড়ির সামনেই একটা মাটির বাড়ি তুলে সেখানেই স্থাপন করলেন লাইব্রেরির ভবন।
তবে লাইব্রেরির অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। আলমারিগুলোতে ঘুণ ধরে ভেঙে পড়ে যেতে শুরু করেছে। এর আগে ১৯৫৮ সালে এটি ‘পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি’ নামে মঞ্জুরী প্রাপ্ত হয়। সে সময় শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো এটি। বছরে অনুদান হিসেবে দেয়া হতো ৫০০ টাকা। ১৯৮০ সালে মন্ত্রণালয় এটিকে জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করে। ২০০০ সালে জেলা প্রশাসক লাইব্রেরিটিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট হস্তান্তরের পরে নিয়মিত আর কোনো অনুদান লাইব্রেরির ভাগ্যে জোটেনি।
তিনি বলেন, এই লাইব্রেরিতে সাময়িক পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য, উপন্যাস, বিশ্বকোষ, ধর্মীয়, কাব্য ও কবিতা, বিজ্ঞান ডিটেকটিব, অর্থনীতি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান বিষয়ে রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার বই। পানিহার লাইব্রেরি ঘুরে গেছেন তৎকালীন মন্ত্রী প্রভাস লাহিড়ী, ধীরেন দত্ত, আইনুদ্দিন চৌধুরী, পল্লীকবি জসিমউদ্দিন, কবি বন্দে আলী মিয়া, উত্তরবাংলার চারণকবি আব্দুল মান্নানসহ আরো অনেকে।
নাচোলের রাণীখ্যাত ইলা মিত্রও এক সময় লুকিয়ে ছিলেন এই গ্রামে। সে সময়টাতে তিনি এই লাইব্রেরিতে এসে পড়তেন। এখনো দেশ বিদেশ থেকে অনেকেই আসেন গবেষণার জন্য।
ফেসবুকে আমাকে পাওয়া যাবে
One thought on "৭০ বছরের পুরোনো রাজশাহীর পানিহার লাইব্রেরি"