দিয়েগো আর্মান্দো
ম্যারাদোনা এবং রাউল রুইদিয়াজের নাম পরপর
উচ্চারণ করলে কেমন হয়? কানে লাগবে
নিশ্চয়ই। ফুটবলার হিসেবে প্রথম জনের কয়েক
আলোকবর্ষের মধ্যে দ্বিতীয় জন থাকবেন
না। প্রথম জন চিরস্মরণীয়। এই গ্রহে ফুটবল
বলে খেলাটা থাকবে যত দিন, ম্যারাদোনা নামটাও
থাকবে তত দিন। দ্বিতীয় জন, রাউল রুইদিয়াজকে
দু’বছর পর লোকে মনে রাখবে তো? পেরু
জার্সিতে দু’বছর পর দেখা যাবে তো?
অনুতাপের হল, ‘বিউটিফুল গেম’-এ ফুটবল-দেবতা
বলে যেমন একটা কথা প্রচলিত আছে, ঠিক
তেমন ফুটবল-অদৃষ্ট বলেও একটা আছে। যে
কখনও অকুণ্ঠ আশীর্বাদ বর্ষণে পুঁচকে
টিমকে স্বর্গদ্বার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আবার
প্রবল রোষে দুঁদে টিমকে দু’টুকরো করে
ফেলতে দু’বার ভাবে না। শুধু টিমই বা বলা কেন?
মহাতারকার সঙ্গে অনামীর পার্থক্যও তো
ফুটবল-অদৃষ্ট সময়-সময় মুছে ফেলে
নিমেষে।
ম্যারাদোনা এবং রুইদিয়াজের ব্যাপারটা এ রকমই কিছু
ভেবে নেওয়া যেতে পারে।
তিরিশ বছর আগের মেক্সিকো সিটির অ্যাজটেকা
স্টেডিয়ামের ঘটনাটা আজও ভোলেনি কেউ।
তৎকালীন ইংরেজ অধিনায়ক পিটার শিলটন
ভোলেননি। উপস্থিত সে দিনের দুই রেফারি
ভোলেননি। ম্যারাদোনা— তিনিও পারেননি
ভুলতে। তিরিশ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের
ফক্সবরোর জিলেট স্টেডিয়ামে যা হল, তা-ও কি
আর কেউ পারবে ভুলতে? পারবে দুঙ্গার
ব্রাজিল? রুইদিয়াজ পারবেন? পারিপার্শ্বিকের
তুলকালাম, দুঙ্গার তীব্র ধিক্কারে ফেটে পড়া,
রিও থেকে ঢাকার ব্রাজিল সমর্থকদের
ক্ষোভের ধূম-উদ্গীরণ দেখলে তো মনে
হবে, আগামী তিরিশ বছরেও কেউ ভুলবে না।
আবার ঈশ্বরের হাত! আবার ঈশ্বরের কুখ্যাত হাত!
নাকি চোরের হাত!
ফুটবল-অদৃষ্টে বিচারের ধরনও বড় অদ্ভুত,
নাটুকে। তিরিশ বছর আগে ম্যারাদোনার ‘ঈশ্বরের
হাত’ ৮৬’ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল
আর্জেন্টিনাকে জিতিয়ে দিয়েছিল। তিরিশ বছর পর
আর এক কুখ্যাত হাত ব্রাজিলকে কোপা আমেরিকা
থেকে বার করে দিল। ছিয়াশিতে জার্মান
প্রেস ম্যারাদোনার সেই গোলকে বলেছিল,
শতাব্দীর কলঙ্ক। ‘স্ক্যান্ডাল অব দ্য সেঞ্চুরি।’
তিরিশ বছর পর রুইদিয়াজকে নিয়ে জার্মান প্রেস
কী বলেছে না বলেছে, সে ভাবে পাওয়া
গেল না। একটা কাগজ দেখা গেল, বিশাল করে
জোয়াকিম লো-র মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি
দিয়েছে। কিন্তু রুইদিয়াজ নেই। কেন?
ম্যারাদোনাটা কলঙ্ক হলে এটা তবে কী?
ব্রাজিলের গোলে সোমবার সকালে যেটা
ঢুকল, তা তো রজার ফেডেরারের ফোরহ্যান্ড!
শোনা যায়, ছিয়াশির সেই ম্যাচের পর অ্যাজটেকা
স্টেডিয়ামের দুই রেফারির কথাবার্তা চিরকালের
মতো বন্ধ হয়ে যায়। তিউনিশিয়ার আলি বিন নাসের
আর বালগেরিয়ার বোগদান দোচেভের মধ্যে
আজও কথাবার্তা নেই। বলা ভাল, ওই ম্যাচের ৫১
মিনিটেই দু’জনের শেষ বাক্যালাপ। পরেরটা
পুরোটাই বিস্ফোরণ-পর্ব। কারণ কিছুই নয়, দায়
স্বীকার। বিন নাসের বহু বছর পর বলেছিলেন
যে, হ্যান্ডবল নিয়ে দোচেভের সঙ্কেতের
অপেক্ষা তিনি সে দিন করেছিলেন। কিন্তু
দোচেভ কিছু করেননি। দোচেভ যার পাল্টা
বলেন, তিনি সহকারী রেফারি ছিলেন। চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত তো প্রধান রেফারিরই হবে। আর
ইউরোপ থেকে রেফারি আনলে ম্যারাদোনার
প্রথম গোল নির্ঘাৎ বাতিল হতো!
গত আগস্টে তিউনিশিয়ায় বিন নাসেরের সঙ্গে
দেখা হয়েছিল ম্যারাদোনার। দেখামাত্র সে
দিনের রেফারিকে জড়িয়ে চুম্বনে-চুম্বনে
ভরিয়ে দেন দিয়েগো! ঈশ্বরের হাতকে
‘ছাড়পত্র’ তো তিনিই দিয়েছিলেন সে দিন। একবিংশ
শতাব্দীর প্রযুক্তি ছিল না তখন। ইন্টারনেট বলে
কোনও বস্তুর আগমন ঘটেনি। দুই রেফারি
ইংরেজদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখে
বুঝেছিলেন, গণ্ডগোল কিছু একটা ঘটেছে।
কিন্তু প্রমাণাভাবে কিছু করতে পারেননি। কিন্তু
মার্কিন মহল্লায় তো সে সব অসুবিধে ছিল না।
রেফারি আন্দ্রে কুনহা ব্রাজিল ফুটবলারদের
বিক্ষোভে পাঁচ মিনিট খেলা থামিয়ে সহকারী
রেফারির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। চতুর্থ
রেফারির সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। এবং সব
শেষে গোল দেওয়া হয়েছে!
তিরিশ বছর পর দেখা হলে আন্দ্রে কুনহাকে
জড়িয়ে রুইদিয়াজ চুম্বন করবেন কি? আপাতত তিনি
ব্রাজিল কোচের ভবিষ্যৎ চরম অন্ধকার গহ্বরে
ঠেলে দিয়েছেন। ‘ওটা পরিষ্কার হ্যান্ডবল ছিল,’
বলেও দুঙ্গা বাঁচতে পারছেন না। তিরিশ বছর পর
তো কোপা-র গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিল
ব্রাজিল। আন্তর্জাতিক মিডিয়া লিখতে শুরু করেছে,
ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) রাখবে না।
বলা হচ্ছে, বিতর্কিত গোল তো হয়েছে
ম্যাচের আটাত্তর মিনিটে। তত ক্ষণ ব্রাজিল কী
করছিল? পেরুর বিরুদ্ধে একটা গোলও করা যাবে
না?
সাংবাদিকদের তীক্ষ্ণ আক্রমণের মুখে পড়ে
দুঙ্গা বলে দিয়েছেন, তিনি চাকরি যাওয়ার ভয় পান না।
সিবিএফ রাখলে রাখবে, ছুড়ে ফেললে
ফেলবে। ‘আমি শুধু মৃত্যুকে ভয় পাই।
বেকারত্বকে নয়। আর আমি কী করছি, সেটা
ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট জানেন!’ সঙ্গে
ক্ষিপ্ত ভাবে যোগ করেছেন, ‘আসলে
ব্রাজিল কোচ হলে জানতে হবে যে, খারাপ
করলে তোমার জন্য সমালোচনার পর্বত
অপেক্ষা করবে।’ ব্রাজিল কোচের ক্ষোভ,
জার্মানির চোদ্দো বছর লেগেছে
পুনর্জাগরণে। সবাই তাই দেখে হাততালি দিচ্ছে।
কিন্তু ব্রাজিলের ক্ষেত্রে কেউ চোদ্দো
মিনিট দাঁড়াতে চাইছে না। দু’মিনিটে রেজাল্ট চাইছে!
‘জার্মানরা কেন পেরেছে? কারণ ওদের ধৈর্য
ছিল। ব্রাজিলিয়ানদের ও সব নেই। কেউ বুঝবেই
না!’
দুঙ্গা ভুল হতে পারেন। দুঙ্গা ঠিক হতে পারেন।
কিন্তু এটা লেখাই যায়, ‘হ্যান্ড অব গড’-এর পরেও
সে দিন ম্যারাদোনার জন্য যে সম্ভ্রম পৃথিবী
রেখেছিল, রুইদিয়াজের জন্য তা রাখবে না।
রাখবেও বা কেন? পেরু ফুটবলার আসল কাজটাই
তো পারেননি। ম্যারাদোনাকে সে দিন ইংরেজরা
শাপ-শাপান্ত করেছিল ঠিকই। জার্মান প্রেসও
লিখেছিল ‘শতাব্দীর কলঙ্ক’। সব ঠিক আছে।
কিন্তু তার পরেও একটা লাইন ছিল।
‘স্ক্যান্ডাল অব দ্য সেঞ্চুরির’ পরেরটা কিন্তু
‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। জিলেট স্টেডিয়ামে
সেটা এলো কোথায়? -আনন্দবাজার
পরুনঃ নারী পুরুষের যৌনতা নিয়ে কিছু সার কথা – যা না
জানলেই নয়