আমরা নিজের সম্পর্কে যে বিচার, মতামত, মূল্যায়ন করি, সেটাই হলো আত্মমর্যাদা। অন্যভাবে বললে, আমাদের সম্পর্কে নিজের যে আবেগীয় মূল্যায়ন এবং নিজের প্রতি নিজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের প্রতি নিজের অনুভূতি, সেটাই হলো আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদা। স্মিথ অ্যান্ড ম্যাকলের মতে, আমরা নিজের সম্পর্কে যা কিছু মনে করি, সেটাই হলো আত্মমর্যাদা।
ক. আত্মমর্যাদা কিভাবে তৈরি হয়
আত্মসম্মান সারাজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি হয়। অতীত অভিজ্ঞতাগুলো যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে আপনার মধ্যে উচ্চ আত্মসম্মানবোধ তৈরি হবে। আর যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে নিম্ন আত্মসম্মানবোধ তৈরি হবে।
অতীত এবং বর্তমান জীবনের সব আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলোও আত্মসম্মান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।যদি আপনার প্রতিটি সম্পর্ক সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারেন, দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে আত্মসম্মানবোধ বেড়ে যাবে।
জীবনে যত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, সবাই হয় আপনার আত্মসম্মানবোধ বাড়িয়ে দিয়েছে; না হয় কমিয়ে দিয়েছে। তবে আত্মসম্মানবোধ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে।
খ.আত্মমর্যাদার প্রকারভেদ
সাধারণত তিন রকমের আত্মমর্যাদাবোধ দেখা যায়। একই ব্যক্তির মধ্যে সময়ের পরিক্রমায় আত্মসম্মানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে পারে। স্ফীত আত্মসম্মানবোধ: নিজের সম্মানকে খুব ফুলিয়ে ফাপিয়ে প্রকাশ করেন।
যতটা না, তার চেয়েও বেশি সে প্রকাশ করেন বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে। তারা মনে করেন, অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক সম্মানিত এবং অনেক উপরে। তাই তারা আশেপাশের সবাইকে খুবই অবমূল্যায়ন করতে পিছপা হন না।এটি খুবই নেতিবাচক আত্মসম্মানবোধ।
যেহেতু এর জন্য ব্যক্তি অন্যদের সাথে স্নেহময় এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না। তারা সব সময় যেকোনো প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকেন এবং যেকোনো মূল্যে সর্বদা শীর্ষে আসতে চান। সফলতাই তাদের কাছে সুখ। তাই যেকোনো মূল্যে অন্যকে খাটো করে, অন্যের ক্ষতি করে তারা সফল হতে চান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরকম মনোভাবের কারণে তারা সত্যিকার অর্থে সুখী হন না।
তারা অন্যের কথা শুনতে চান না এবং নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না বা মেনে নেন না। নিজের ভুল-ভ্রান্তিগুলো শুধরে নিতে চান না। অনবরত অন্যকে দোষারোপ করে থাকেন। উপরন্তু তারা অন্যদের অবমূল্যায়ন করেন এবং তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেন। এ ধরনের স্ফীত আত্মসম্মানী মানুষের পক্ষে অন্যদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। তারা সব সময় অন্যকে নিজের প্রতিপক্ষ মনে করেন।
গ. উচ্চ আত্মসম্মানবোধ
উচ্চ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি যেমনই হোক, নিজেকে গ্রহণ করেন এবং নিজেকে মূল্য দেন। এটি ইতিবাচক আত্মসম্মান। যেখানে ব্যক্তি নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। তাদের জীবনে যে বাধা-বিপত্তিগুলো আসে, সেটা তারা নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও সাহস দিয়ে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যান।
আমেরিকান-কানাডিয়ান সাইকোথেরাপিস্ট নাথানিয়েল ব্রান্ডেনের মতে, ‘উচ্চ আত্মসম্মানী ব্যক্তি নিজেদের অন্যের চেয়ে উচ্চতর বা অন্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে পরিচালিত হন না। তারা অন্যের সাথে নিজেকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করেন না বা নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন না।
তারা যেমন আছেন তেমনই সুখী অনুভব করেন। তারা অন্যের চেয়ে ভালো হওয়ার বা অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার মধ্যে সুখ খুঁজতে চান না।’এ ধরনের মানুষ সব সময় নতুনদের সাথে মিশতে পছন্দ করেন, নতুন বা চ্যালেঞ্জিং এবং সৃজনশীল কাজ করতে পছন্দ করেন। অন্যরা তাদের কিভাবে মূল্যায়ন করবেন, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। নিজে যেমন, তেমনই নিজেকে প্রকাশ করেন।
কোনো ভুল করলে সেটা মেনে নিয়ে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। তারা অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং নমনীয়তা তাদের আচরণে পরিলক্ষিত হয়। জীবনের উত্থান-পতনের সাথে তারা মানিয়ে নিতে পারেন। উচ্চ আত্মমর্যাদার অধিকারী মানুষ তাদের জীবনের সব আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলো সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারেন।
ঘ. নিচু আত্মমর্যাদা
উচ্চ আত্মমর্যাদার পুরোপুরি বিপরীত হলো নিচু আত্মমর্যাদা। নিজেরাই নিজেদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না, নিজেকে মূল্যহীন মনে করেন। নিজেদের সামর্থের উপর নির্ভর করতে পারেন না। সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কোনো কাজ শুরু করার আগেই ব্যর্থতার ভয় পেয়ে বসে।
তারাই মূলত অসুখী মানুষের মডেল।সব কিছু যদি সঠিকভাবে চলে, তাহলে নিচু আত্মমর্যাদার লোকজন আনন্দে সময় কাটান। কিন্তু যখনই কোনো ছোটখাটো বিষয় খারাপ হয়, তখনই তাদের আত্মমর্যাদা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তারা অন্যদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হন।
নিজের কোনো ভুলের জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। তারা অন্যদের মত কখনোই ভালো বা সেরা হতে পারবেন না, এমন মনোভাব পোষণ করেন।তারা বেশিরভাগ সময়ই একা থাকতে পছন্দ করেন। সৃজনশীল বা নতুন কোনো কাজ শুরু করতে চান না ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে।
তারা সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা করেন কিন্তু কিছুই করেন না। ‘আমি কিছুই পারবো না, আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়, আমি একজন অসফল মানুষ’- এরকম মনোভাব পোষণ করেন সব সময়। আত্মমর্যাদা বাড়ানোর উপায়: যদিও আত্মমর্যাদাবোধ ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে। তবুও নিন্মোক্ত উপায়গুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আত্মমর্যাদা বাড়াতে চেষ্টা করতে পারেন।
One thought on "আত্মমর্যাদা বা আত্মসম্মান কি?"