হলিউডের অ্যাকশন মুভি এবং কল অফ ডিউটি এর মতো গেমের কল্যানে নাইট ভিশন গগলস এর কথা কারো অপরিচিত নয়।Wild life ডকুমেন্টরি, বিভিন্ন দেশের মিলিটারি এবং কি আপনাদের বাসায় ব্যবহৃত সিসিটিভিতেও ব্যবহার হচ্ছে নাইট ভিশন প্রযুক্তি। কিন্তু আপনি কি জানেন এই নাইট ভিশনও ৩ প্রকার হতে পারে?

বনে জঙ্গলে বিভিন্ন সময়ে প্রানীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন হয়। সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালান পর্যবেক্ষন, বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণে নাইট ভিশন গগলসের ব্যবহার হয়ে আসছে।রাতের গাঢ় অন্ধকারে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এ প্রযুক্তি।

কাজের‌‌ ধরন অনুযায়ী এই নাইট ভিশন গগলস ৩ ধরনের হয়ে থাকে।

অ্যাকটিভ ইল্যুমিশন( Active iillumination)
ইমেইজ ইন্টেন্সিফিকেশন (image intensification)
থার্মাল ইমেজিং(Thermal imaging)

চলুন দেখে নেয়া যাক এগুলোর বিস্তারিত।


অ্যাকটিভ ইল্যুমিশন( Active iillumination)

এই ধরনের নাইট ভিশন গগলসের কাজের ধরন‌ বোঝার জন্য আমাদের কিছু বেসিক সাইন্স প্রয়োজন।
প্রথমটি হচ্ছে আলো।আলো মূলত তরঙ্গ আকারে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়।

আলোর এসব তরঙ্গের একটা ওয়েব লেংথ হয়ে থাকে।চোখের সামনে আমরা যেসব আলো দেখি তাদের ওয়েব লেংথ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার। ১ ন্যানোমিটার হচ্ছে 1×10^−9m। এর বেশি বা কম হলে আমরা খালি চোখে দেখতে পাইনা।

এবার জানতে হবে একটি ক্যামেরা কিভাবে কাজ করে। আলো যখন বিভিন্ন জায়গায় যেমন চেয়ার টেবিল ইত্যাদিতে আপতিত হয় তখন সেটা আবার বাউন্সব্যাক করে।আলোর ফোটন আমাদের চোখে পড়ে আমরা দৃশ্যমান বিষয়গুলো দেখি।

ঠিক ক্যামেরাতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ক্যামেরার সেন্সর আলোর ফোটনকে ক্যাপচার করে। ফোটন যখন ক্যামেরার সেন্সরে পড়ে তখন সেটি সেন্সরের ইলেকট্রনকে আঘাত করে।

এই ফোটন যখন ইলেক্ট্রনকে আঘাত করে তখন চার্জের সৃষ্টি হয়।পরে সেটি ডাইভার্ট হয়ে ভোল্টেজে পরিনত হয়।যেটা পরে ক্যামেরার পিক্সেলের মাধ্যমে আমাদের ছবি দেখায়‌।

অ্যাকটিভ ইল্যুমিশন নাইট ভিশন এটি দ্বারাই তৈরী করা হয়। এটাতে থাকে একটি ক্যামেরা আরেকটি টর্চলাইট।তবে এই টর্চ‌লাইট বাসা বাড়ির মতো টর্চলাইট না।

দৃশ্যমান আলোর বদলে এই টর্চলাইট ইনফ্রারেড আলো নিক্ষেপ করে।এই নিক্ষিপ্ত আলো আমরা দেখতে পাই না। কারন ইনফ্রারেড আলোর ওয়েবলেংথ ৭০০ ন্যানোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার হয়ে থাকে ।যেটি আমাদের খালি চোখে দেখার আলো (৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার) থেকে অনেক বেশি হয়ে থাকে।

এই ইনফ্রারেড আলোর থেকে যখন ফোটন বাউন্সব্যাক করে ক্যামেরায় ফেরত আসে সেটি তখন প্রসেস করে আমাদের রাতের অন্ধকারের
দৃশ্য দেখায়।

অ্যাকটিভ ইল্যুমিশন এর কিছু অসুবিধা আছে।

১. এটি শুধুমাত্র যতটুকু ইনফ্রারেড আলো পৌছায় ততটুকু দেখতে পায়।

২.এটির যেহেতু ক্যামেরার সাহায্যে আমাদের দেখায় তাই এটি দিয়ে সাবলীল দৃশ্য দেখা যায় না। কারন ক্যামেরার ফ্রেইমরেইট কম হয়ে থাকে।


ইমেইজ ইন্টেন্সিফিকেশন (image intensification)

এই প্রযুক্তির উপর গড়ে উঠা নাইট ভিশন সাধারনত মিলিটারিতে ব্যবহৃত হয়। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির উপর গড়ে উঠেছে।

১ম টাইপের এখানে আলোর নিঃসরন হয়,যদিও সেটি ইনফ্রারেড কিন্ত তাও সেটি আলো দেখায়।অর্থাৎ মিলিটারিতে এ ধরনের নাইট ভিশন ব্যবহার করলে শত্রুর কাছে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।কারন আলো অনেক দূর থেকে দেখা যায়।

এই অসুবিধা দূর করার জন্য এ ধরনের অ্যাকটিভ ইল্যুমিশন ব্যবহারের চেয়ে এখানে ব্যবহৃত হয় ইমেইজ ইন্টেন্সিফিকেশন প্রযুক্তি।এখানে কোন ধরনের টর্চ থাকে না যেটি ইনফ্রারেড আলো নিক্ষেপ করে।

এই টেকনোলজিতে আলোর ফোটনকে ফিজিক্যালি বুস্ট করা হয়।এখানে কোন প্রকার ক্যামেরা,ডিসপ্লে কিংবা টর্চ ব্যবহার করা হয়না।

এই টেকনোলজি মাইক্রোচ্যানেল প্লেইট ও ফটোক্যাথোড টিউব দিয়ে গঠিত।এটা অ্যানালগ‌ প্রযুক্তি।কারন এখানে ক্যামেরার মতো ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার হয়‌না।


এ ধরনের নাইট ভিশন সাধারনত ৩ ধরনের জিনিস নিয়ে গঠিত।আলোর ফোটন প্রথমে আসে ফটোক্যাথোড টিউবে।এই ফটোক্যাথোড টিউব সেমিকন্ডাকটর ও অ্যালক্যালাইন দিয়ে গঠিত।ফোটন যখন এখানে আসে তখন ক্যাথোডের ইলেকট্রন উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ে।

এই ইলেক্ট্রন‌ একটি ভ্যাকুয়াম দ্বারা মাইক্রোচ্যানেল প্লেইটের সাথে আবদ্ধ।এই প্লেইটে প্রায় ৬ মিলিয়ন ছোট ছোট চ্যানেল আছে যেগুলো দিয়ে ইলেক্ট্রন প্রবেশ করতে পারে। এটি নিচের দিকে ৫ ডিগ্রী বাঁকা অবস্থায় থাকে।ইলেক্ট্রন যখন এই প্লেইটের চ্যানেল দিয়ে যায় সেখান থেকেও আরো ইলেক্ট্রন নিঃসৃত হয়।

এখানে দুটি মাইক্রোচ্যানেল প্লেইট থাকে একটিতে চ্যানেলগুলো ৫° বাঁকানো আরেকটি সোজা।বাঁকানো প্লেইট থেকে আরো‌ ইলেক্ট্রন নিয়ে এটি সোজা করা প্লেইটের ভিতর দিয়ে বের হয়ে যায়।

এই ইলেক্ট্রনের স্রোত ফসফোর স্ক্রিনে গিয়ে আঘাত করে।এই স্ক্রিন ইলেকট্রনের প্রবাহে জ্বলে উঠে।এটি ইলেক্ট্রন থেকে আবার দৃশ্যমান ফোটনে কনভার্ট করে দেয়। এগুলো অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে কানেক্টেড থাকে যেটি দিয়ে ফাইনাল স্ক্রিনে আমরা দৃশ্য দেখি।

মোটামুটি এই হলো এটির কাজ করার ধরন। যেহেতু কোন ডিজিটাল জিনিস নেই, তায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু দেখা যায়। আর এখানে লাইটের দরকার পড়ে না। এজন্য এই প্রযুক্তি মিলিটারিতে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এটির‌ও কিছু অসুবিধা আছে।

১.এটি বেশ খরুচে তৈরীতে।

২.এটির একটি লাইট সোর্স দরকার (সেটি খুবই সামান্য যেমন তারার আলো)।কারন যেহেতু এটি ফোটন নিয়ে কাজ করে।

৩.প্রচন্ড ধরনের অন্ধকার যেমন আন্ডার গ্রাউন্ড টানেলে এটি অকার্যকর। কারন সেখানে আলোর কোন প্রকার সোর্স নেই। সেটির জন্য অ্যাকটিভ ইল্যুমিশন( Active iillumination)ই ভালো। কারন সেখান থেকে ইনফ্রারেড আলো নির্গত হয়।


থার্মাল ইমেজিং(Thermal imaging)

এটি সাধারনত রেডিয়েশনের উপর ভিত্তি করে তৈরী। এটি ডিজিটাল সিস্টেম।এটির জন্য সেন্সর,ডিসপ্লে ইত্যাদির দরকার হয়।

প্রতিটি বস্তু থেকে রেডিয়েশন‌ নির্গত হয়। এই রেডিয়েশন এই প্রযুক্তি ডিটেক্ট করে সেটি দৃশ্য দেখায়।
যেসব জায়গায় কোন ধরনের লাইট সোর্স নেই এবং ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ সেসব জিনিস দেখতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হয়। এটিই সবচেয়ে হায়েস্ট প্রযুক্তি।

এটির দেখার সক্ষমতা অন্য দুটো ধরন থেকে অনেক বেশি। এটির দেখার রেঞ্জ ও বিশাল। যেহেতু এটি ফোটন‌ নয় বরং রেডিয়েশন নিয়ে কাজ করে তাই এর কোন‌ লাইট সোর্সের‌ও দরকার হয়না।

এটির এত সুবিধা থাকার পর‌ও এটির জনপ্রিয়তা কম।কারন এগুলোর পোর্টেবিলিটি কম।এসব যন্ত্রপাতি বিশাল হয়ে থাকে। তাছাড়া এটি ছোট ছোট অবজেক্টের লেখা ধরতে পারে না। কারন এটি রেডিয়েশনের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি কেবলমাত্র থার্মাল ইমেজ টাইপ ছবি প্রদর্শন করতে পারে।

এটি সাধারনত ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত হয়। হসপিটালের মেডিকেল চেক‌আপ, কনস্ট্রাকশন সাইটে, বিভিন্ন রেসকিউ অভিযানে এটির ব্যবহার হয়ে থাকে।

নাইট ভিশন প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার। বিজ্ঞান তার জায়গা থেকে এই অন্ধকারকে জয় করে নিয়েছে।সামনে আরো বিভিন্ন প্রযুক্তি আসতে চলেছে। সময়‌ই বলে দিবে বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা কোথায় গিয়ে পৌছাবে। প্রযুক্তি ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে, ভবিষ্যতে আমরা আরো নানা গুরুত্বপূর্ণ টেকনোলজির দেখা পাবো।আজ এই পর্যন্তই।

Leave a Reply