আরাফার দিনের গুরুত্ব ও রোজার ফজিলত
আরবী মাসের সর্বশেষ মাস পবিত্র জিলহজ মাসের ৯ তারিখ হলো ইয়াওমে আরাফা তথা আরাফায় অবস্থানের দিন। এই দিনটি হজ্জ আদায়ের জন্য যারা পবিত্র খানায়ে কাবায় গমন করেছেন একইসাথে যারা গমন করেননি তেমন প্রত্যেক মুসলিমের জন্যই একটি মহা মর্যাদাপূর্ণ দিন। কারণ এই দিনে আল্লাহ তা’য়ালা তার বান্দাহদের প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হিসেবে দ্বীন আল ইসলামকে পরিপূর্ণতা ঘোষনা করেছেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা আল মায়িদার ৩নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا
অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের মনোনীত দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা আল মায়িদা, আয়াত নং ৩)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে আকাশবাসীর সঙ্গে গর্ব করেন। তিনি তাদের বলেন, আমার বান্দার দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা আমার কাছে এসেছে উশকোখুশকো ও ধূলিমলিন অবস্থায়।’ (মুসনাদ আহমদ : ২/২২৪)
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখকে (ঈদুল আযহার আগের দিন) ‘ইওয়ামুল আরাফাহ’ বা ‘আরাফার দিন’ বলা হয়, কারণ এই দিনে হাজীরা আরাফাহ নামক একটা মাঠে জমায়েত হন। হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ আহকাম হলো যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ ‘আরাফার ময়দানে’ অবস্থান করা। এই দিনের গুরুত্ত্ব সম্পর্কে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হলো হাজ্জ।” (সুনানে নাসায়ি: ৩০৪৪ )
যারা হজ্জে যাবেন তারা কি আরাফার দিনে রোজা রাখবেন?
হাজীদের জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা সুন্নত নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায়ী হজ্জকালে আরাফার দিন রোযা রাখেননি।
সহিহ বুখারীতে মায়মুনা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার দিন রোযা রেখেছেন; নাকি রাখেননি এ ব্যাপারে কিছু মানুষ সন্দেহে ছিল। তখন আমি তাঁর জন্য এক পেয়ালা দুধ পাঠালাম; তখন তিনি আরাফার ময়দানে অবস্থান করছিলেন। তিনি দুধ পান করলেন; লোকেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল।” [মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন, খণ্ড ২০, প্রশ্ন ৪০৪]
তাই হজ্জপালনকারীর জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা মাকরূহ; মুস্তাহাব নয়।
যারা হজ্জে যাবেন না তাদের আরাফার দিনে রোযা রাখার ফজিলতঃ
‘ইয়াওমে আরাফা’র রোযা সম্পর্কে প্রসিদ্ধ হাদীস,
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله والسنة التي بعده‘ইয়াওমে আরাফার রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের ও পরের একবছরের গোনাহ মাফ করবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬২)
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
“আরফার দিনের রোজার ছওয়াব এক হাজার দিন রোজা রাখার সমান।” (তারগিব)
আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরাফাতের দিন জাহান্নাম থেকে যতো অধিক সংখ্যক বান্দাকে নাজাত দেন, অন্য কোন দিন এতো অধিক বান্দাকে নাজাত দেন না।
মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ এ দিন (বান্দার) নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের নিকট গৌরব করে বলেনঃ তারা কী চায়?(মুসলিম ১৩৪৮, নাসায়ী ৩০০৩, সহীহাহ ২৫৫১)
পবিত্র হাদীস গ্রন্থের অনুমোদিত আরাফার দিবসের আরো কিছু আমল
এছাড়াও আরাফার দিবসে নিম্নোক্ত আমলগুলো হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে অনুমোদিত
- গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের কামনা করা
- অধিক পরিমাণে জিকির ও দোয়া করা
- জোরে কিংবা আস্তে তাকবীর পাঠ করা মোস্তাহাব:
- আত-তাকবীরুল মুতলাক : যে তাকবীর যিলহজ মাসের ১ থেকে ১৩ই যিলহজ পর্যন্ত দিন রাতের যে কোন সময় / সর্বদা পাঠ করা যেতে পারে।
- আত-তাকবীরুল মুকাইয়াদ : বা বিশেষ সময়ের তাকবীর। এ তাকবীর যিলহজ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পরে তাকবীর পাঠ করতে হবে।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে এমন আমল করার তাওফীক দান করেন যাতে তিনি সন্তুষ্ট হবেন। তিনি যেন আমাদেরকে দীনের জ্ঞান দান করেন এবং ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা কেবল তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নেক আমল সম্পাদন করে।আমীন।
আরাফার রোজা ৯ তারিখেই, ৮ তারিখে না
আরাফার দিন রোজা রাখার কথা হাদীসে এসেছে। এজন্যেই কেউ কেউ বলতে চান, যেদিন হাজী সাহেবগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন, সেদিনই রোজা রাখতে হবে। তারা হয়তো মনে করেন, আরাফার দিনের এ রোজার মূলে আরাফার মাঠে হাজীদের অবস্থান। এ অবস্থানকে কেন্দ্র করেই আরাফার দিনের রোজা এতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আসলে বিষয়টা এমন নয়। কারণ :
1. আরাফার দিনের রোজা আরাফার মাঠের আমল নয়। যারা আরাফার মাঠে অবস্থান করেন, অর্থাৎ হাজী সাহেব যারা, তাদের জন্যে সেদিন রোজা রাখা সুন্নত নয়। তারা সেদিন স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করবেন, যেন অতিরিক্ত কোনো ক্লান্তি ও দুর্বলতা তাদের আক্রান্ত না করে এবং হজের আমলগুলো তারা ঠিকঠাক পালন করতে পারেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও আরাফার মাঠে অবস্থান কালে রোজা রাখেননি। যারা আরাফার মাঠের বাইরে থাকেন, অর্থাৎ যারা হজ করতে যাননি, এ রোজাটি তাদের জন্যেই। বোঝা গেল, আরাফার দিনের রোজার মূলে আরাফার মাঠ নয়।
2. আরাফার দিন একটি পরিভাষা। একটি বিশেষ দিনের নাম। জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন বলা হয়, ঠিক যেমন ১০ তারিখকে বলা হয় ইয়াওমুন নাহর বা জবাইয়ের দিন, ১১-১৩ তারিখকে বলা হয় আয়্যামুত তাশরীক বা তাশরীকের দিনসমূহ, মহররম মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা ইত্যাদি। আরাফার দিনও এমনই একটি পরিভাষা। যে দেশে যেদিন জিলহজ মাসের ৯ তারিখ, সে দেশে সেদিনই আরাফার দিন। আরাফার দিন মানে যেদিন হাজী সাহেবগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন সেদিন নয়। যে হাদীসে আরাফার দিনের রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, সে হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাখ্যাই করেছেন- এখানে আরাফার দিন বলে ৯ জিলহজ উদ্দেশ্য।
3. আলেমগণ এ বিষয়ে একমত- ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন আর ইয়াওমে নাহরের মাঝে কোনো গ্যাপ নেই। আরাফার দিনের পরদিনই হলো ইয়াওমুন নাহর বা জবাইয়ের দিন। একটি ৯ তারিখ, আরেকটি ১০ তারিখ। হাদীসে যেমন ৯ তারিখের রোজাকে আরাফার দিনের রোজা বলা হয়েছে, তেমনি কুরবানির দিনকেও ইয়াওমুন নাহর বলা হয়েছে। তাই যদি আমরা আমাদের দেশে থেকে ৮ জিলহজ আরাফার দিনের রোজা পালন করি, তবে ১০ তারিখ ইয়াওমুন নাহরের আগে আরেকটি দিনের গ্যাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের ব্যাখ্যাবিরোধী।
4. কোনো দেশে যদি সৌদি আরবের একদিন আগে চাঁদ দেখা যায়, তবে তারা যেদিন ঈদ পালন করবে, অর্থাৎ তাদের ১০ তারিখ যেদিন, সেদিন সৌদি আরবে থাকবে ৯ তারিখ এবং সেদিনই হাজী সাহেবগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করবেন। তারা যদি নিজ দেশের হিসেবে ৯ তারিখে আরাফার রোজা না রেখে সৌদি আরবের ৯ তারিখ হিসেবে রোজা রাখতে চান, তবে তা হবে তাদের ঈদের দিন অর্থাৎ ১০ তারিখ। আর ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম।
তাই আমরা যদি জুমহুর আলেমগণের মত অনুসরণ করি, নিজ নিজ দেশের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চান্দ্র মাসের হিসাব করি এবং সে হিসেবেই নিজেদের ৯ তারিখে আরাফার রোজা রাখি, তবে সেটাই হবে সঠিক পন্থা এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা উপরের সংকটগুলো থেকেও বেরিয়ে আসতে পারব। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, আরাফার দিনের রোজার ফজিলত পেতে হলে ৯ তারিখেই রাখতে হবে, তা সৌদি আরবে যত তারিখই হোক না কেন।
সুতরাং, সামনের বুধবার ৯ তারিখ আরাফার রোজা রাখতে হবে। তাই ৮ তারিখ রাতে মঙ্গলবার সেহরি করে নিবেন।
আপনি চাইলে নিচের লিংক থেকে গিয়ে Arabic Date দেখতে পারেন।
আমি যখন পোস্টটি লিখছি আজ Hijri date: ৭ই জিলহজ।
Arabic Date দেখতে চলে যান এই লিংকেঃ https://techhelpbd.com/date/
তবে সবচেয়ে ভালো আমল তারাই করছেন- যারা জিলহজ মাসের ১ তারিখ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখবেন। এতে আরাফার রোজা তো পাওয়া যাবেই, একইসঙ্গে তারা অনেক সওয়াব ও ফজিলত লাভ করবেন।
কেননা হাদিসে এসেছে,
জিলহজের ১ থেকে ৯ তারিখ প্রতিদিনের রোজা ১ বছরের রোজার সওয়াব এবং প্রতিরাতের ইবাদত ১ বছরের ইবাদতের সমান সওয়াব। (তিরমিজি, খণ্ড:১, পৃষ্ঠা-১৫৮)
4 thoughts on "আরাফার রোজা কত তারিখ? আট জিলহজ, নাকি নয় জিলহজ?"