গল্পে জল্পে জেনেটিক্স বই রিভিউ



গল্পে জল্পে জেনেটিক্স। নাম শুনেই পাঠক বুঝতে পারছেন বইটির আলোচ্য বিষয় কি হতে যাচ্ছে। জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা, জীববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান মৌলিক শাখা। জীববিজ্ঞান এমনিতেই আমাদের ছাত্রদের কাছে বেশ ভীতিকর, সেখানে জেনেটিক্স যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা রীতিমতো নীরস, কাটখোট্টা। কিন্তু যখন দেখবেন লেখকের (অনুবাদকের — প্রকৃতপক্ষে) নাম চমক হাসান, তখন একটা বিজলি-চমক আপনার মাথায় খেলে যেতে বাধ্য।

চমক হাসান পড়েছেন তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে, তার অনুরাগীদের কাছে সমধিক জনপ্রিয় গণিত – শিক্ষক হিসেবে, জেনেটিক্সের বইতে সেই ব্যক্তির নাম! অবশ্য লেখকের নাম পাঠককে খানিকটা স্বস্তি দেবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কেননা নামটি চমক হাসান, কঠিন-জটিল, জিলাপির প্যাঁচযুক্ত বিষয়ের জট খুলে তাকে সহজ করে বোঝাতে হাসিখুসি চেহারার এই মানুষটির যে জুড়ি মেলা ভার।

গল্পে জল্পে জেনেটিক্স — চমক হাসানের প্রথম প্রকাশিত বই। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে বইটি একটি ইংরেজি বইয়ের রূপান্তর। মূল বইটি হলো বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ল্যারি গনিকের ‘এ কার্টুন গাইড টু জেনেটিক্স। বইটির সহলেখক ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মার্ক হুইলিস। ল্যারি গনিক সবচে জনপ্রিয় তার কার্টুন গাইড সিরিজের জন্য। দ্যা কার্টুন গাইড টু ফিজিক্স, দ্য কার্টুন গাইড টু কেমিস্ট্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। ইংরেজিতে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ তে। আর এর রূপান্তর ”গল্পে জল্পে জেনেটিক্স” দুই খণ্ডে প্রথম বের হয় অন্যরকম প্রকাশনী থেকে, ২০১২ অমর একুশে বইমেলায়। এ বছরের বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনী থেকে বইটি বেরিয়েছে — নতুনভাবে এবং নতুনরূপে।

এবার আসি বইয়ের কথায়……………
স্পষ্টতই জেনেটিক্সের বিভিন্ন মৌলিক বিষয় আলোচনাই এই বইয়ের মূল উপজীব্য। জীববিজ্ঞান থেকে আমরা জানি আমাদের যাবতীয় দেহতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করে জিন। কিন্তু আমাদের দেহে কীভাবে কাজ করে সেই জিন? কিভাবে মানুষ আবিষ্কার করলো সেই অতি ক্ষুদ্র বস্তু? আগামী শতাব্দী কি জিন প্রকৌশলের শতাব্দী হতে চলেছে? মানুষ কি পারবে ঠিক তার মতোই আরেকজন মানুষ ক্লোন করে ফেলতে? এই সব প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে বহু বছর আগে শুরু হওয়া জীবনের এক গল্পের মাঝে, যার অংশ আমরা সবাই।

“গল্পে জল্পে জেনেটিক্স”—এ সেই গল্পটাই বলা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, পুরো বইটিই কমিক্সের আকারে লেখা এবং ততধিক মজার ছবি আর কার্টুনে ভরপুর।রসালো সব কার্টুনে জেনেটিক্সের একদম মৌলিক বিষয়গুলিই সন্নিবেশিত হয়েছে এখানে। কমিক্স আকারে লেখা হলেও বইটি তার বিষয়বস্তুতে বেশ সিরিয়াস। মাধ্যমিক পর্যায়ের কোষ বিভাজন, ডিএনএ, আরএনএ থেকে শুরু করে বায়োটেকনলজি, মলিকুলার বায়োলজির মতো ইউনিভার্সিটির জেনেটিক্স কোর্সের সমপর্যায়ের বিষয়বস্তুও স্থান পেয়েছে এতে। মুখবন্ধে বিজ্ঞানশিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে কাজ করে যাওয়া আরেক বিজ্ঞানসৈনিক, ডাক্তার সৌমিত্র চক্রবর্তীর ভাষ্য।

“বইটা পড়া যতোই এগোতে থাকে, ততই আমি বিস্মিত হতে থাকি। একী! এতো দেখছি মেডিকেল প্রথম বর্ষের বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়টির অন্তর্ভুক্ত জেনেটিক্স কার্ডটির পুরোটাই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে আরো অনেক কিছু পেলাম, যা ঐ কার্ডে ছিলো না কিন্তু থাকলে ভালো হতো… পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিলো ইশ, প্রথম বর্ষে থাকতে যদি বইটা পেতাম, তাহলে জেনেটিক্স কার্ডটাকে ঐরকম বিভীষিকা মনে হতো না। ভাবুন তাহলে একবার ব্যাপারখানা!

বইটিতে খুব গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে জেনেটিক্সের অগ্রগতির ইতিহাস এবং বিভিন্ন আবিষ্কারের পেছনে বিজ্ঞানীদের অবদানের গল্প। এই বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই জন্যে যে গতানুগতিক পাঠে আমরা শুধু থিওরির জটিল বুলি গুলোই আত্মস্থ করে যাই। এর পেছনের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো জানার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। এ বইতে বেশ যত্নের সাথেই জেনেটিক্সের ক্রমোন্নতির একেকটি পর্যায় এবং সেই পর্যায়ক্রমিক উন্নতির পেছনে কাজ করা বিজ্ঞানীদের তুলে ধরা হয়েছে।

এর সাথেই সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় বলি, বইটির বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা অসাধারণ। কোন বিষয়টির পর কোনটির অবতারণা করলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে, পাঠক যেনো নিজেকে কূল — কিনারাহীন অথৈ সাগরে হারিয়ে না ফেলেন, বরং ধাপে ধাপে জেনেটিক্সের গভীরে ঢুকতে পারেন, হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন বিষয়গুলো। সেই বিষয়টি এখানে নিশ্চিত করা হয়েছে‌ সুন্দরভাবে। আবার বইটিতে কিছুদূর পর পর গিয়ে যেখানে যেমন প্রয়োজন, সেখানে পূর্বের তত্ত্বগুলো মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে, যা রীতিমতো প্রশংসনীয়।

বইটির আরেকটি সুন্দর দিক হচ্ছে এর অঙ্কন।মাইটোসিস – মিয়োসিস, ডিএনএ, আরএনএ, কোডন, অ্যামিনো এসিডের জটিল – বিদঘুটেও নয়, আবার ছেলেভুলানোও নয়। বরং বেশ পরিচ্ছন্ন ড্রয়িং পাঠকের মন কাড়বে। আগেই বলেছি, চমক হাসান বায়োলজির ছাত্র নন, বাংলাভাষী বিজ্ঞানপ্রেমীদের প্রতি নেহায়েৎ দায়বদ্ধতা থেকেই করেছেন অনুবাদ। ‘এ কার্টুন গাইড টু জেনেটিক্স’ এর মতো বই বা তার অনুবাদ বাংলা ভাষায় খুব বেশি এসেছে তা বলা যায় না, তবে আসা যে অতি প্রয়োজনীয় এ বিষয়ে বোধ করি সকলেই একমত হবেন।

চমক হাসানকে বেশ বড়সড় একটা ধন্যবাদ, এই মানের একটি বইকে বাংলায় রূপান্তর করে আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। তার অনুবাদের হাত অসাধারণ প্রাঞ্জল। অত্যন্ত সহজ – সাবলীল শব্দ ব্যবহার করে পাঠককে জেনেটিক্সের জটিল জগতে নিয়ে গেছেন তিনি। যদিও এটি তার প্রথম কাজ, কিন্তু অনুবাদের ভঙ্গি একদম অনাবিল, জড়তার লেশমাত্র নেই। ইংরেজি থেকে রূপান্তরের সময় মূল বক্তব্য অক্ষুণ্ন রেখে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপযোগী করেই অনুবাদ করা হয়েছে বইটি।

পাঠক যদি মূল ইংরেজি বইটির সাথে মিলিয়ে পড়তে পারেন, তবে স্বভাবতই চমক হাসানের অনুবাদের তারিফ না করে পারবেন না। যেমন ধরুন, বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় ল্যারি গনিক শুরু করেছেন এভাবে,”I’m in a scientific mood… “আর চমক হাসানের অনুবাদ,”হুম…আমি একটু ‘ভাবে’ আছি… কেমন জানি বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী ভাব! অর্থাৎ তিনি একেবারেই আক্ষরিক অনুবাদের পথ বেছে নেন নি, যা তাঁর রূপান্তরকে করে তুলেছে প্রাঞ্জল এবং সুখপাঠ্য।অনুবাদকের উন্নত হিউমারের পরিচয় পাঠক পাবেন উৎসর্গ অংশে, যেখানে চমক হাসান লিখেছেন, “প্রজনন’—কে, যাকে ছাড়া এই বইটি, বইটি যারা লিখেছেন কিংবা বইটি যারা পড়বেন— কারও অস্তিত্বই সম্ভব ছিলো না !”

শুধু এটুকুই নয়, সারা বইজুড়েই রয়েছে মজার সব কৌতুক, জেনেটিক্স পড়ানোর সাথে সাথে পাঠককে যা আনন্দ দেবে পুরোদমে। বইটির সবচেয়ে দারুণ দিক বোধ করি এটাই, যে বইটি পড়তে পারবে সবাই — প্রাথমিক বিষয়গুলো যেমন কৌতূহলী দশম শ্রেণি পড়ুয়ারাও বুঝবে, তেমনি জটিল বিষয়গুলো হয়তো ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদেরও পড়া বুঝতে সাহায্য করবে।

ইতিহাস থেকে শুরু করে বায়োটেকনলজি আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্স থেকে ফ্রান্সিস-ক্রিকের ডিএনএ রেপ্লিকেশন – ট্রান্সক্রিপশন, ভিক্টোরিয়া পরিবারের হিমোফিলিয়া থেকে অতি পুরুষ সমস্যা XYY সিনড্রোম, জৈববিবর্তনের আলোকে জেনেটিক্সের বিশ্লেষণ। কি নেই এখানে? তারচে’ও বড় কথা হচ্ছে, “জীববিজ্ঞান এবং জেনেটিক্স সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেবে বইটি, খুব কম বইয়েরই থাকে যে ক্ষমতা”।
জীবনের পাঠ যে মোটেই পানসে নয়, ক্লান্তিকর নয়-বরং ততোধিক চমকপ্রদ, আনন্দদায়ক—এই কথা পাঠক অনুভব করবেন তার অন্তরে। কেননা, বইয়ের কথাতেই বলি, “আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছেছি যখন সবাইকেই হতে হবে একেকজন জীববিজ্ঞানী আর গোটা পৃথিবীকেই হতে হবে তাদের পাঠশালা।”
তবে আর দেরী কেনো? এখনই বইটি অর্ডার করুন অথবা pdf বইটি ডাউনলোড করে পড়ুন। হ্যাপি রিডিং ?

বইয়ের নামঃ গল্পে জল্পে জেনেটিক্স
বইয়ের লেখকঃ চমক হাসান
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১১২ টি প্রায়
ক্যাটেগরিঃ জীববিজ্ঞান
পিডিএফ সাইজঃ ৩০ মেগাবাইট প্রায়।
ডাউনলোডঃ গল্পে জল্পে জেনেটিক্স pdf


আরো পড়ুনঃ ১। ছেলে সন্তান পেটের কোন দিকে থাকে | ছেলে সন্তান পেটের কোন দিকে নড়ে?

২। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত মহিলা সাহাবীদের নামগুলো অর্থসহ | জান্নাতি মহিলা সাহাবীদের নামগুলো

আমার ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার আমন্ত্রণ রইলো www.puretrick99.com

Leave a Reply