কাশী এক মোক্ষক্ষেত্র। এখানে মৃত্যু মানে পুনর্জন্মের চক্র থেকে একেবারেই ছুটি। সেই বিশ্বাসকে আজও আশ্রয় দেয় একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে কী নামে ডাকা হবে, তা অবশ্য নির্ধারণ করা দুরূহ।
কাশীতে মারা গেলে সোজা মোক্ষ— এই বিশ্বাস সহস্রাব্দ-প্রাচীন। যুগে যগে ভারতীয় হিন্দুর এই বিশ্বাস তাকে টেনে এনেছে গঙ্গার পশ্চিম কুলের এই ‘মোক্ষক্ষেত্রে’। আজ থেকে ১০০ বছর পিছিয়ে গেলেই দেখা মিলত বারাণসীর ঘাটে অন্তর্জলি হচ্ছে কারোর। অশীতিপর বৃদ্ধ তাঁর শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন হাঁ করে, সামনে গীতার চতুর্থ অধ্যায় শেষ করে এনেছেন শিখাধারী পণ্ডিত, পিতলের ঘটি থেকে ক্ষীণ ধারায় নেমে আসছে গঙ্গাজল, অন্ত্যেষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছেন একান্ত পরিজন। বিলাপ ছড়িয়ে পড়ছে, কাঠের পরে কাঠ সাজিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে অগ্নিশয্যার আধার, মনিকর্ণিকা জ্বলে উঠছে, রামধ্বনি-হরিধ্বনিতে ভরে যাচ্ছে চরাচর।
সেদিন আজ আর নেই। অন্তর্জলি আজ একেবারেই অবাস্তব এবং ‘অমানবিক’ কল্পনা। কিন্তু সারা ভারতই কি একই রকমভাবে চিন্তা করে? আজও বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে কাশী এক মোক্ষক্ষেত্র। এখানে মৃত্যু মানে পুনর্জন্মের চক্র থেকে একেবারেই ছুটি। সেই বিশ্বাসকে আজও আশ্রয় দেয় একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে কী নামে ডাকা হবে, তা অবশ্য নির্ধারণ করা দুরূহ। কেউ তাকে ধর্মশালা বলতে পারেন, কেউ ‘হোটেল’ বলেও ডাকতে পারেন। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে আসলে এক মৃত্যু-প্রতীক্ষালয়।
কাশীর ‘মুক্তি ভবন’ কিন্তু কখনওই এক ‘ইউথ্যানশিয়া’-কেন্দ্র নয়। কোনও আধুনিক কনসেপ্টকেই সে স্থান দেয়নি তার জন্মলগ্ন থেকেই। তার অভিধানে একটাই শব্দ— ‘মোক্ষ’। আর সেটাকেই সে প্রদান করতে চায় তার বাসিন্দাদের। প্রতি বছর বেশ কিছু মানুষ এখানে আসেন স্রেফ ‘মরতে’। তাঁরাই এই ‘হোটেল’-এর বোর্ডার। মুক্তি ভবন তাঁদের সঙ্গে তাঁদের পরিজনকেও থাকার জায়গা দেয় নামমাত্র কাঞ্চনমূল্যে। যাঁরা দিতে পারেন, দেন। যাঁরা পরেন না, তাঁদেরও ‘মোক্ষ’ নিশ্চিত থাকে এখানে। তবে মুক্তি ভবনের নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুপথযাত্রী বোর্ডার দু’সপ্তাহ থাকতে পারেন এখানে। কিন্তু সেই সময় অতিক্রান্ত হলে তাঁকে সরে যেতে হয় ‘সিট’ থেকে, অন্যের ব্যাকুল মৃত্যুপথ থেকে।