আসসালামু আলাইকুম

আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।

আমার আগের তিনটি পর্ব:-

পর্ব ১:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১

পর্ব ২:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২

পর্ব ৩:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩

পর্ব ৪:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪

9.ইবনে বকর(এনেসথেসিয়া পদ্ধতির আবিষ্কারক)

ইবনে-বকর। একজন ওষুধ বিজ্ঞানী। উদ্ভাবক। আবিষ্কারক। এসব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব। সাধারণ অনুভূতিনাশক বা এনেসথেসিয়ার প্রয়ােগ পদ্ধতির সূচনা করেন এই প্রাজ্ঞজন। এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছিলেন আফিম। তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী ইবনে-বকরের পুরাে নাম : আবু বকর মােহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজী। সম্ভবত তিনি জন্মেছিলেন ইরানের রাই নামের একটি স্থানে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে তাকে শুধু তুলনা করা চলে প্রতিভাপুরুষ আবু সিনার সাথে। ইবনে সিনা নামে যিনি সমধিক পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে-বকরের অবদান অনন্য ও অসাধারণ। তিনিই সর্বপ্রথম স্পষ্ট করে পার্থক্য ধরিয়ে দেন স্মল পক্স ও চিকেন পক্স রােগের।

অর্থাৎ গুটি বসন্ত আর জল বসন্ত যে এক রােগ নয়, সেটা প্রথম আমরা জানতে পারি ইবনে বকরের কাছ থেকেই। শল্যচিকিৎসকরা মাঝে মধ্যেই পড়তেন এক হতবুদ্ধিকর অবস্থায়, তখন তিনি নিয়ে আসেন নামে এক নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা। অনুভূতিবিলােপ বা এনেসথেসিয়া নামে তা আজ সর্বত্র ব্যবহার হয়। অবশ্য প্রথম তিনি এ কাজে আফিমের ব্যবহার করেন। তিনি বেশ কিছু অ্যাসিডের সূত্রায়ন করেন। সালফিউরিক অ্যাসিড এগুলােরই একটি। তিনি সূষম অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ণ পথ্য তালিকা প্রণয়ন করেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি যে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তাতে সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি আবির্ভূত হলেন ভেষজবিদ্যার ক্ষেত্রে একজন শীর্ষ সারির পণ্ডিতজন হিসেবে। তেমনি পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন গণিত, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন বিষয়েও।

তিনি সে সময়ের বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের কাছে শিক্ষা লাভের সুযােগ লাভ করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযােগ্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন উল্লেখযােগ্য শিক্ষাবিদ হুনান ইবনে ইসহাক। গ্রীস, পারস্য ও ভারতে অর্জিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের রাজ্যে ইবনে-বকর গভীরভাবে বিচরণ করেন। আলী ইবনে রাব্বানের মতাে শিক্ষকের ছাত্র হবার গৌরব অর্জন করেছিলে আলী ইবনে রাব্বান ছিলেন সে সময়ের এক সুবিখ্যাত শিক্ষাবিদ।

আবু বকর কর্মজীবন শুরু করেন মুখতাদী হাসপাতালে। একজন ইন্টার্নি ডাক্তার হিসেবে সেখানে কাজ শুরু করেন। তিনি ইচ্ছেমতাে সাফল্যের সাথে সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মদক্ষতার সুপ্রমাণিত নজির সৃষ্টি সূত্রে তিনি রাই-এর ইস্পেরিয়েল হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। সেখানেও তিনি অসাধারণ কর্মসফলতার প্রমাণ দেন। তাকে তখন আবার ফিরিয়ে আনা হয় বাগদাদের মুখতাদী হাসপাতালে।

এবার তিনি এলেন হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে। হেকিম ডাক্তার হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লাে। এশিয়ার সব জায়গা থেকে ছাত্ররা দলে দলে তাঁর কাছে পড়তে আসতে লাগলাে। আবু বকরের ছাত্র হওয়াটা ছিল একটা সুযােগের ব্যাপার। তিনি সুদীর্ঘ সময় কাটান এই হাসপাতালে কাজ রে। তিনি জ্ঞানান্বেষণে ভ্রমণ করেছেন নানা দেশ। আবার জ্ঞান বিতরণের জন্যেও কখনাে গিয়েছেন অন্য দেশে।

জীবনের শেষ দিকে তিনি চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে চারটি বই লিখে যান। বইগুলাের নাম : কিতাব -মুনসুরী, কিতাব আল-মুলকি, আল-হাবি এবং কিতাব আল-জুদারি ওয়া আল-হাসাবা। এই বইগুলাে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছে।

এখনাে মূল্যবান বই হিসেবে বিবেচিত বই ‘কিতাব আল- মুনসুরী’ একটি বড় মাপের কাজ। পঞ্চদশ শতকে এই বইটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। দশ খন্ডের এই বইটিতে গ্রীক ও আরবীয় ওষুধ ব্যবস্থা ও থেরাপী নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। এর কয়েকটি খন্ড অনান্য ইউরােপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। গুটি বসন্ত ও জলবসন্ত নিয়ে আলোচনা আছে বই কিতাব আল-জুদাবি ওয়া আল-হাসাবায়। গুটি বসন্ত তখন গােটা বিশ্বে ছিলাে এক মহামারীবিশেষ । তিনি প্রমাণ করেন, এ রােগ দুটি এক নয়। এগুলাের জন্যে প্রয়ােজন আলাদা আলাদা চিকিৎসা।

আবু বকরের অবদান ছিল বিস্ময়কর। তার কর্মসাফল্য সূত্রে এশিয়া ও ইউরােপের মানুষেরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। তার পরেও একজন হেকিম বা ডাক্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল।

এখন হেকিম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা, এরা হচ্ছেন, হালুয়ার প্রস্তুতকারক। আর এরা বড় জোর স্বদেশী লতাপাতার বড়ি তৈরি করতেই পারেন। কিন্তু এক সময় হেকিম বলতে বুঝাতাে ডাক্তারদের ডাক্তার-‘ডক্টর অব ডক্টরস’। ইউরােপীয় ভাষা এই অর্থটুকুর মধ্যে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দিয়েছে।

একটি কর্মসফল কর্মজীবন শেষে আবু বকর ফিরে যান নিজের জন্মস্থানে। তিনি সেখানেই মারা যান ৯০০ খৃষ্টাব্দে। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।

10.আল ফারগানি(ফলিত প্রকৌশলের অগ্রদূত)

আমরা আজ পৃথিবী নামের যে গ্রহটিতে বসবাস করছি, সে গ্রহ সম্পর্কে আমাদের জানা নানা দিককেন্দ্রিক। কিন্তু এক সময় মানুষ পৃথিবী নামের গ্রহটির ব্যাস কত, তাও জানতাে না। প্রথম মানুষ করে এর ব্যাস সম্পর্কে জানলাে, তা নিয়ে কখনও আমরা কী ভেবে দেখেছি? আর এও কী জানি, একাজটি প্রথম সম্পাদন করেন একজন মুসলিম বিজ্ঞানী।

এই বড় মাপের আবিষ্কারটি করেন আবুল আব্বাস আহমেদ ইবনে- হিম্মদ ইবনে কাত্তির আল-ফারগানি। যিনি পশ্চিমা বিশ্বে আলফ্রাগানুস নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন আরব অথবা পারস্যর একজন সুন্নি মুসলিম জ্যোতির্বিদ।

নবম শতাব্দীতে তিনি ছিলেন বিশ্বের খ্যাতনামা একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। চাঁদের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আলফ্রাগানুস এর নামকরণ তার নামেই করা হয়েছে।

তিনি জন্মেছিলেন ট্রান্স অক্সিয়ানার ফারগীনায়। ফারগানা হচ্ছে তাসখন্দের দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের একটি উপত্যকা।

তাঁর জন্ম তারিখ জানা যায়নি।তবে তিনি নবম শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক দলিলপত্র ঘেটে জানা যায়, তিনি খলিফা আল-মামুনের অধীনে একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন।

আল ফারগানি জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়নে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত সুদক্ষ প্রকৌশলী।

বাগদাদে ৭ম আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন এর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়ের কাজে নিয়োজিত বিজ্ঞানীদের দলে তিনিও ছিলেন।

ফারগানি দেখিয়েছিলেন, পৃথিবী নামের গ্রহের ব্যাস ৬৫০০ মাইল। তিনি অন্যান্য গ্রহের ব্যাসও মাপতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সবচেয়ে দূরের ইন্টার-প্ল্যানেটারী ডিসটেন্স বা আন্তঃগ্রহের দূরত্ব পরিমাপ করেছিলেন।

পরবর্তীতে তিনি কায়রো চলে যান। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পুরোনো কায়রোয় গ্রেট নাইলোমিটার(Great Nilometer) এর নির্মাণ কাজে আল-ফারগানি তত্ত্বাবধান করেন।

এই নাইলােমিটার ছিল ট্রাইগ্রিস থেকে পানি আনার একটি খাল খনন পরিকল্পনা। এ খাল কাটা শেষ হয় ৮৬১ খৃষ্টাব্দে। খলিফা মুতাওয়াক্কুল এ খাল খননের আদেশ দিয়েছিলেন। এটা ছিল অবাক করা এক প্রকৌশল কর্ম। তখন পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ ঘটেনি।ফারগানি প্রকৌশল ও প্রযুক্তিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে বলা হয় Pioneer in Applied Engineering বা ফলিত প্রকৌশলের অগ্রদূত।

তিনি সৌর ব্যবস্থায় গ্রহ-উপগ্রহ কীভাবে পরিভ্রমণ করছে, তার ওপর একটি বই লিখে গেছেন তিনি। সেখানে তিনি ছায়াপথ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটি এ ক্ষেত্রে একটি অনন্য বই। বইটির নাম জাবামি লিম আল নুজম’। দ্বাদশ শতকে এই বইটি লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়। এটি ‘এলিমেন্টস অব এস্ট্রোনমি নামে সুখ্যাতি অর্জন করে। দীর্ঘদিন ধরে ইউরােপে এটি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক অন্যতম প্রধান বই। বলা যায় প্রতিনিধিত্বশীল বই। তার সবচে বিখ্যাত বই হচ্ছে ঝামী বা Jhamee। এর অর্থ elements ।

তাঁর অন্য দু’টি বিখ্যাত বইয়ের একটি ‘কিতাব আল ফাসুল ইখতিয়ার আল মাজিস্টি’ অথবা The book of Chapreens’ ! এটি আল মাজিস্ট-এর সার সংক্ষেপ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কিতাব আল আইরুখামাত অথবা Book on the Construction of Sundials | TIE বই-ই লাতিন ভাষায় ভাষান্তর হয়েছে।

পরবর্তী সময়ের ইউরােপীয় জ্যোতির্বিদেরা তাঁর এসব অনুবাদিত বইয়ের কাছে ব্যাপকভাবে ঋণী। ৯৬৭ খৃষ্টাব্দে আব্দুল আজিজ আল কারিমী ফারগানির বই ‘জামি’ নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেন। এর পাণ্ডুলিপি ইস্তাম্বুল জাদুঘরে এখনও পাওয়া যায়।

মহান বিজ্ঞানীর শেষ জীবনের দিনগুলাে সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে তিনি সাফল্যের সাথে খলিফা মুতাওয়াক্কুলের নির্যাতন মােকাবিলা করেছিলেন। তিনি অদম্যভাবে বরাবর চলে গেলেন জ্ঞানার্জনের পথে।তাকে ৮৬১ খৃষ্টাব্দে হত্যা করা হয় ।

5 thoughts on "ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫"

    1. Abir Ahsan Author Post Creator says:
      Thanks
  1. Shakil Contributor says:
    আপনি জানান, আমরাও আরো জানতে চাই

Leave a Reply