কারবালার ইতিহাস
শাহাদাতে কারবালা
ইয়াজিদের মসনদ দখল
ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা ত্যাগ
কুফার চিঠি
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর কূফা গমন
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর প্রতি প্রাণঢালা সংবর্ধনা
কূফাবাসীর বেঈমানী ও হযরত ইমাম মুসলিমের শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কূফা গমন
কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রাঃ)
অবরোধ সৃষ্টি ও পানি বন্ধ
ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর আকুল আহবান
ঐতিহাসিক ১০ই মুহররম
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর অনুসারীদের শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর মর্মস্পর্শী ভাষণ এবং হুরের সপক্ষ ত্যাগ
চাচাত ভাই ও সৎভাই এর শাহাদাত
হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাসান (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম কাসেম (রাঃ) এর শাহাদাত
ভাগিনাদ্বয়ের শাহাদাত

হযরত আব্বাস (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত আলী আসগর (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শেষ উপদেশ ও যুদ্ধের ময়দানে গমন
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর বীর বিক্রম আক্রমণ
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর লাশের পার্শ্বে হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) ও হযরত সখিনা (রাঃ)
ইমাম পরিবারকে কূফায় আনয়ন
ইবনে যিয়াদের নিষ্ঠুর আচরণ
শহীদ পরিবার ও খন্ডিত মস্তক মুবারক দামেস্কে প্রেরণ
ইয়াজিদের দরবারে শহীদ পরিবার ও ইয়াজিদের ভন্ডামী
শহীদ পরিবারের মদীনা শরীফ প্রত্যাবর্তন
রওজা পাকে ইমাম জয়নুল আবেদীন (রাঃ)এর হাজেরী

সৈয়দুশ্ শোহদা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের ৫ তারিখে মদিনা শরীফে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের পর সরকারে মদিনা (সাঃ) তাঁর কানে আযান দিয়ে দুআ করেছিলেন। সাত দিন পর আকিকা করে ‘হুসাইন’ নাম রাখা হয়েছিল। হাদিস শরীফে বর্নিত আছে,
আল হাসনু ওয়াল হুসাইনু ইসমানে মান আহলিল জান্নাত -অর্থাৎ “হাসান ও হুসাইন জান্নাতী নাম সমূহের মধ্যকার দুটি নাম।
এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু’নামের প্রচলন ছিল না।
হযরত হাসান ও হুসাইন (রাঃ) হুযুর আকরাম (সাঃ) এর খুবই প্রিয় ছিলেন। তাঁদের ফযিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্নিত আছে। হুযুর (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-
ইন্নাল হাসানা ওয়াল হুসাইনা হুমা রাইহানি মিনাদ্দুনিয়া। – অর্থাৎ “নিশ্চয়ই হাসান-হুসাইন দুনিয়াতে আমার দুটি ফুল”।
আপন সন্তান থেকেও তিনি তাঁদেরকে অধিক ভালবাসতেন।
হযরত আল্লামা জামী (রঃ) বর্ননা করেন, একদিন সরকারে দোআলম (সাঃ) হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে ডানে ও স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইব্রাহীম (রাঃ) কে বামে বসিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় জিবরাইল (আঃ) উপস্থিত হয়ে আরজ করিলেন-ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ! আল্লাহ তাআলা এ দুজনকে আপনার কাছে এক সাথে রাখতে দিবেন না। ওনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিবেন। অতএব আপনি এ দু’জনের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পছন্দ করেন। হুযুর (সাঃ) ফরমাইলেন, যদি হুসাইনকে নিয়ে যায়, তাহলে ওর বিরহে ফাতেমা ও আলীর খুবই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুণ্ণ হবে, আর যদি ইব্রাহীমের ওফাত হয় তাহলে সবচেয়ে দুঃখ একমাত্র আমিই পাবো। এজন্য নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমাই পছন্দ করি। এ ঘটনার তিনদিন পর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ইন্তেকাল করেন।
এরপর থেকে যখনই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হুযুর (সাঃ) এর সমীপে আসতেন, হুযুর ওকে মুবারকবাদ দিতেন, ওর কপালে চুমু দিতেন এবং উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বলতেন- আমি হুসাইনের জন্য আপন সন্তান ইব্রাহীমকে কুরবানি দিয়েছি। (শাওয়াহেদুন নবুয়ত)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন এমন অবস্থায় বাইরে তাশরীফ আনলেন যে, উনার এক কাঁধের উপর হযরত হাসান এবং অন্য কাঁধের উপর হযরত হুসাইনকে বসিয়ে ছিলেন। এভাবেই আমাদের সামনে তাশরীফ আনলেন এবং ইরশাদ করলেন-
ﻣﻦ ﺍﺣﺒﻬﻤﺎ ﻓﻘﺪ ﺍﺣﺒﻨﻰ ﻭﻣﻦ ﺍﺑﻐﻀﻬﻤﺎ ﻓﻘﺪ ﺍﺑﻐﻀﻨﻰ

অর্থ: ‘যে এ দু’জনকে মুহব্বত করলো, সে আমাকে মুহব্বত করলো। আর যে এদের সাথে দুশমনী করলো, সে আমার সাথে দুশমনী করলো।’
হযরত ইমাম হুসান (রাঃ) এর জন্মের সাথে সাথে হুজুর (সঃ) এর বদৌলতে তার শাহাদাতের কথা সবার কাছে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হযরত আলী, হযরত ফাতিমাতুয যাহরা, অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বাইতের সংশ্লিষ্ট সকলেই (রাঃ) হুসাইন (রাঃ) এর শৈশবাবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, এ ছেলেকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং কারবালার ময়দান তার রক্তে রঞ্জিত হবে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে ।
হযরত উম্মুল ফজল বিনতে হারিছ (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা) (হযরত আব্বাস (রাঃ) এর স্ত্রী) বলেন, আমি একদিন নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে তার কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুযূর (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ! (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যাপার কি ? তিনি ফরমালেন, আমার কাছে হযরত জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এসে এ খবর দিয়ে গেলেন- ﺍﻥ ﺍﻣﺘﻰ ﺳﺘﻘﺘﻞ ﺍﺑﻨﻰ ﻫﺬﺍ ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।’ হযরত উম্মুল ফজল (রাঃ) বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে আরয করলাম, “ইয়া রসূলাল্লাহ, এ শিশুকে শহীদ করবে! হুযূর (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমালেন, ‘হ্যাঁ! জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) ওর শাহাদাত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন।
হযরত ইবনে সা’দ (রাঃ), হযরত শা’বী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) জঙ্গে সিফফীনের সময় কারবালার পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই জায়গার নাম জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এ জায়গার নাম কারবালা। কারবালার নাম শুনামাত্র তিনি এত কান্নাকাটি করলেন যে, মাটি চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছিল। অতঃপর ফরমালেন, আমি একদিন হুযূর (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খিদমতে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম, তিনি কাঁদছেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ! (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি কেন কাঁদছেন? ফরমালেন, এইমাত্র হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এসে আমাকে খবর দিয়ে গেলেন-
ﺍﻥ ﻭﻟﺪﻯ ﺍﻟﺤﺴﻴﻦ ﻳﻘﺘﻞ ﺑﺸﺎﻃﺊ ﺍﻟﻔﺮﺃﺕ ﺑﻤﻮﺿﻊ ﻳﻘﺎﻝ ﻟﻪ ﻛﺮﺑﻼ
আমার ছেলে (দৌহিত্র) হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে ফোরাত নদীর তীরে যে জায়গায় শহীদ করা হবে, সে জায়গার নাম কারবালা।’ ।
— সাওয়ায়িকে মুহার্রাকা
বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত সম্পর্কে হুজুর (সঃ) অনেকবার ভবিষ্যদ্বানী করেছেন । ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শৈশবকালেই এটা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিল । হুযুর (সঃ) খোদাওয়ান্দ তা’আলার ইচ্ছায় রেজামন্দি জ্ঞাপন করেন । জলেস্থলে যার হুকুম চলে, পাথর বৃক্ষ পশু-পাখি যাকে সালাম করে, যার ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, যার হুকুমে ডুবন্ত সূর্য ফিরে আসে এবং খোদা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সৃষ্টিকুলের প্রতিটি কনায় কনায় যার রাজত্ব চলে, সেই নবী (সঃ) তার প্রানপ্রিয় দৌহিত্রের শাহাদত হওয়ার খবর পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন বটে কিন্তু রক্ষা করার জন্য খোদার বারগাহে দুয়া করেননি । এমনকি হযরত আলী ও হযরত ফাতিমা (রাঃ) এ বলে আরয করেননি- ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ! হুসাইনের শাহাদতের খবর শুনে আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে । আপনি আল্লাহর দরবারে এ মসীবত থেকে রক্ষার জন্য দুয়া করুন ।’
মোটকথা কেউ ওকে রক্ষার জন্য দুয়া করেননি, সবাই চেয়েছেন যে, হযরত হুসাইন (রাঃ) যেন এ মহা পরীক্ষায় কামিয়াব হয়ে আল্লাহ্ (আযযা ওয়াজাল্লা) এর দরবারে উচ্চস্থান লাভ করেন ।
অতি পরিতাপের বিষয়, আমাদের মধ্যে মুসলমান নামধারী কেউ কেউ বলে থাকে যে, নবী করিম (সঃ) পরের উপকার তো দূরের কথা, নিজের উপকার করতেও অক্ষম’ (নাউজুবিল্লাহ) । তাঁদের প্রধান দলীল হলো, ‘রাসুলুল্লাহ যখন স্বীয় দৌহিত্রকে হত্যা থেকে বাঁচাতে পারেননি, সে ক্ষেত্রে অন্যদেরকে মসীবত থেকে কিভাবে রক্ষা করতে পারবেন’ । এর জবাব হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সঃ) হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) কে শহীদ হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেননি । তিনি (সঃ) ইমাম হুসাইন (রাঃ) কে হত্যা থেকে রক্ষার জন্য দুয়া করেননি । যখন তিনি (সঃ) রক্ষা করার জন্য চেষ্টাই করেননি, তখন এটাকে অক্ষমতা বলাটা মারাত্মক ভুল ।
মনে করুন, আমাদের কোন লোক নদীতে ডুবে যাচ্ছে । কিন্তু আমাদের কাছে নৌযান ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ওকে রক্ষা করার জন্য আমরা চেষ্টা করিনি । এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে কি অক্ষম বলা যাবে ? অবশ্য আমরা যদি চেষ্টা করে বিফল হতাম তাহলে অক্ষম বলা যেত ।
আমাদের সমাজে এখনো অনেক ইয়াজিদের প্রেতাত্মা রয়ে গেছে । ওরা সুযোগ বুঝে আহলে বায়ত ও ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করে না । এদেরকে চিনে রাখা এবং এদের সম্পর্কে সজাগ থাকা দরকার ।

Leave a Reply