আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের সব পর্ব:-
পর্ব ১:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
পর্ব ২:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
পর্ব ৩:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩
পর্ব ৪:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪
পর্ব ৫:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫
পর্ব ৬:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬
14.আবুল ওয়াফা (ত্রিকোণমিতির মূল স্থপতি)
দশম শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ অংকশাস্ত্রবিদ আবুল ওয়াফা ৯৪০ খৃস্টাব্দের ১০ জুন মােতাবেক ৩২৮ হিজরীর ১ রমজান পারস্যের খােরাসান প্রদেশের বুজ্জান নগরের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরাে নাম, ‘আবুল ওয়াফা মােহাম্মদ ইবনে মােহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে ইসমাইল ইবনে আল আব্বাস আল বুজ্জান । তার অর্জন ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ।
তিনি গোলাকার ত্রিকোণমিতিতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছিলেন এবং ব্যবসায়ীদের জন্য পাটিগণিত বিষয়ে তাঁর রচনায় মধ্যযুগীয় ইসলামিক পাঠে প্রথম Negative সংখ্যা ব্যবহারের করেন এবং সঠিক ত্রিকোণমিতি সারণী নির্মাণ করেছিলেন।
তিনি তার চাচা সম্পৰ্কীয় আবু আমর ও আবুল আবদুল্লাহ নামক দু’জন শিক্ষকের কাছে অংকশাস্ত্রে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। এরপর ৯৫৯ খৃস্টাব্দ থেকে তিনি বাগদাদে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশােনায় মনােনিবেশ করেন।
আবুল ওয়াফার গবেষণার কেন্দ্রভূমি ছিল বাগদাদ। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি চলে যান বাগদাদে। সর্বোচ্চ মাত্রার শিক্ষাগত যােগ্যতা অর্জনের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন আবুল ওয়াফা। গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে এক গভীর জ্ঞান-ভাণ্ডারের সৃষ্টি করে।
এই সময়ে বুওয়াহিদ পরিবার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে ইসলামী বিশ্বে পরিবর্তন আসে।তারা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহ প্রদানের জন্য পরিচিত ছিল।খুব শীঘ্রই তিনি বুওয়াহিদ দরবারে শীর্ষস্থানীয় জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন, এবং আল – তিবনে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনা করেন।
তিনি অংকশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ত্রিকোনমিতিতে পারদর্শী ছিলেন। শুদ্ধ অংকশাস্ত্রের উপর বেশী জোর দেওয়ায় তিনি এক্ষেত্রে বেশী সাফল্য লাভ করেছিলেন। আল-বাত্তানীর পরে যে বিজ্ঞান ৪০ বছর পর্যন্ত মৃতপ্রায় ছিল, তা তার দ্বারা পুনরুজ্জীবন লাভ করে। বাত্তানীর অসমাপ্ত কাজ এবং মঁসিয়ে মেডিলাের মতে টলেমির চন্দ্র সম্বন্ধীয় গণনার অসম্পূর্ণতা পূরণের উদ্দেশ্যে তিনি নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা শুরু করেন। কেন্দ্র ও স্থানচ্যুতির সমীকরণ তারই অবদান। এর পূর্বে কেউ তা জানতেন না।
গ্রীক বৈজ্ঞানিকগণ চন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় অসমতা জানতেন কিন্তু চন্দ্রের তৃতীয় অসমতা তাঁরই আবিষ্কার। পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকগণ ইতােপূর্বে এ সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। এমন কি তাঁর মৃত্যুর পর ৬ শত বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকদের তা উপলব্ধিরও বাইরে ছিল।
আধুনিক Astronomy-তে এই অসমতা Variation নামে উল্লেখ করা হয়। মসিয়ে মেডিলাের মতে আবুল ওয়াফা-ই এর সর্বপ্রথম আবিষ্কারক।
চাঁদ সম্পর্কিত তার আবিষ্কার নিয়ে প্রবল সমালােচনার মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু সময়ের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, তার আবিষ্কার ছিল যথার্থ অর্থেই সঠিক। তার আবিষ্কারের ৬০০ বছর পর।আল-ওয়াফার মূল জ্যোতির্বিজ্ঞান রচনা এবং এই বিষয়ে তাঁর একমাত্র বিদ্যমান লেখটি হ’ল কিতাব আল – মাজিস্ট।
কোন স্থান থেকে কেবলার অবস্থান নির্ণয় যে কোন কালের মসুলমানের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ কেবলামুখী হয়ে নামায পড়া ও মসজিদ নির্মাণ মুসলমানদের ইমানের সঙ্গে জড়িত বিষয়। প্রায় সকল মুসলিম বৈজ্ঞানিক এ বিষয় কিছু না কিছু চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। ইবনে ইউনুস, আল বাত্তানী প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকদের এ বিষয়রে কাজের কথা উল্লেখ করা যায়। ইবনে ইউনুস প্রথম এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু পুরােপুরি সফল হতে পারেন নাই। আবুল ওয়াফাই তাঁর আল মাজিষ্টিতে প্রথম এ বিষয়ে বিস্তৃত হিসাব লিপিবদ্ধ করেন।
তাঁর জ্যোতির্বিদ্যার কাজের সম্মানে, তাঁর জন্য চাঁদে একটি গর্তের নামকরণ করা হয়েছে।
আবুল ওয়াফার মূল অবদান গণিতের বিশেষত জ্যামিতি এবং ত্রিকোণমিতির বিভিন্ন শাখায়।আল- বাত্তানীর স্বপ্ন আবুল ওয়াফার দ্বারাই বাস্তবায়িত হতে থাকে।
তাঁর কাছ থেকে আমরা যেসব মূল্যবান ও অনন্য-সাধারণ অবদান পেয়েছি, সেগুলাের বেশির ভাগই ত্রিকোণমিতি ও জ্যামিতি বিষয়ক। তিনিই ত্রিকোণমিতির মূল স্থপতি। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান অমূল্য। জ্যামিতিতে কম্পাস ব্যবহারের কৃতিত্ব তাঁর। এই একটি উদ্ভাবন নানা সমস্যা সমাধানের সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়।
একটি বর্গের সমান আরেকটি বর্গ কীভাবে আঁকতে হয়, তিনিই প্রথম তা আমাদের জানান। তিনিই প্রথম আকার দেন অধিবৃত্ত বা প্যারাবােলার। বহুতলা বা পলিহাইড্রা তিনিই প্রথম তৈরি করে দেন।
হেক্টাগনও তাঁরই সৃষ্টি।
তিনি তৈরি করেন অভাবনীয় জ্যামিতিক সমীকরণ। এর সমাধানও দেন তিনি নিজে।যেমন:-
x4 = a,
x4 + ax3 = b
আবুল ওয়াফার ত্রিকোণমিতির বিকাশে ব্যাপক অবদান ছিল। তিনিই প্রথম গােলকীয় ত্রিভুজের সঙ্গে কোণের সাইন প্রভৃতির সাধারণ সম্পর্ক স্থাপন করে ত্রিকোনমিতিকে বিজ্ঞানসম্মত করে তােলেন।
তিনি গোলাকার ত্রিকোণমিতির প্রাচীন পদ্ধতিগুলি সরলকরণ করেছিলেন এবং সাধারণ গোলাকার ত্রিভুজের জন্য law of sine প্রমাণ করেছিলেন ।
তিনি সাইন টেবিল নির্মাণের একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন,এতে Sin 30° এর মান অষ্টম দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিক ছিল ।(যখন টলেমির কেবলমাত্র 3 টি স্থানে ছিল।)
আবুল ওয়াফা উদ্ভাবন করেন সাইন থিওরেম। সাইন টেবল তাঁরই তৈরি করা। ট্যাঞ্জেন্টে বা স্পর্শক এবং স্পর্শক সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞানার্জন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর অধ্যাবসায় বৃথা যায়নি।
গণিতবিদ্যার ‘ট্যাঞ্জেন্ট টেবল’ আমরা পেয়েছি আবুল ওয়াফার কাছ থেকে। জ্যামিতির নানা শাখা প্রশাখার সত্যিকারের উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। কোণিক জ্যামিতি বা কোনিক্যাল জিওম্যাট্রির বিভিন্ন বিষয়ে ছিল তার গভীর জ্ঞান।
আল- বাত্তানীর স্বপ্ন আবুল ওয়াফার দ্বারাই বাস্তবায়িত হতে থাকে। পূর্বেকার অস্ফুট ত্রিকোনমিতি ক্রমশ পূর্ণায়নের দিকে এগিয়ে চলে। এর উপপাদ্য, প্রমাণ, প্রমাণিত বিষয়াদি সুষ্ঠু নিয়মে প্রচলন করেন আবুল ওয়াফা। দুই কোণের সাইনের সমষ্টি যে সাইন ও কোসাইন দ্বারা নির্ণয় করা যায়, তা প্রথম উদ্ভাবণ করেন তিনি। বর্তমান ত্রিকোনমিতিরি ফরমূলা–
Sin (α+β) = Sinα cosβ + cosα Sinβ
sin (α −β) = sinα cosβ −sinβ cosα
cos(α +β) = cosαcosβ −sinαsinβ
cos(α −β) = cosαcosβ +sinαsinβ
Sin এবং Tan এর সারণী 15° ব্যবধানে সংকলন করার জন্যও তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় । তিনি Secant and Cosecant ফাংশনগুলিও প্রবর্তন করেছিলেন এবং এদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
পাশাপাশি একটি চাপের সাথে যুক্ত ছয়টি ত্রিকোণমিতিক লাইনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কেও তিনি বর্ণনা করেন।
তিনি অর্ধ /দ্বিগুণ angle এর সূত্র বিকাশ করেন।
2 sin2 = 1- cos X
sin2x = 2 six cosx
sin 2x = sin(x + x) = sin x cos x + cos x sin x = 2 sin x cos x
sin (2θ) = 2sinθcosθ
cos(2θ) = cos2θ −sin2θ
আল-ওয়াফা প্রথম বর্গক্ষেত্র বিভক্ত করা এবং পুনরায় একত্রিত করার একটি গাণিতিকভাবে সঠিক পদ্ধতিটি তুলে ধরেছিলেন।প্রকৃতপক্ষে আজকের ত্রিকোণমিতির একটি বড় অংশ আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি।
তার সবচেয়ে মূল্যবান বইটির বিষয় গণিত। বইটির নাম: ‘কিতাব লিম আল-হিসাব’। তার আরেকটি বিখ্যাত বই : ‘কিতাব আল হাসা’ । প্রথমটি তাঁর নানা লেখার একটি সঙ্কলন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভৌত জ্যামিতি বিষয়ে একটি খাঁটি বই। ইউক্লিড, ডিওফেন্টস ও আল-খাওয়ারিজমী সম্পর্কে তিনি মূল্যবান বিশ্লেষণ রেখে গেছেন। তবে এগুলাে আজ আর পাওয়া যায় না।
তিনি পণ্ডিত ডাওফেন্টস রচিত বীজগণিতের আরবী অনুবাদ করেন। ঐতিহাসিক ত্যাজোরীর মতে তিনিই গ্রীক গ্রন্থের সর্বশেষ অনুবাদক। তার পরে আর গ্রীক গ্রন্থের অনুবাদ হয়নি।
আবুল ওয়াফারও লিখিত বহু মূল্যবান গ্রন্থের আজ আর সন্ধান পাওয়া যায় না। কেবল আবুল ফারদাসের ঐতিহাসিক গ্রন্থে উল্লেখ ছাড়া তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাঁর রচিত যে গ্রন্থাগুলাের নাম জানা যায়:-
১. কিতাব ফি মাইয়াহতাজ ইলায়হি আল-কত্তাব ওয়াল ওম্মান ইলমুল হিসাব’; ব্যবসা সংক্রান্ত পুস্তক;
২.আল কিতাবুল কামিল। এই গ্রন্থের কতকাংশ ক্যারা দ্য গে কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছে;
৩. কিতাবুল হান্দামা’ ব্যবহারিক জ্যামিতি। বর্তমানে এটি প্যারি গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে;
৪. ‘কিতাবুল মানাজিল ফিল হিসাব অংকের ক্রমিকস্তরের পুস্তক;
৫. কিতাবুল মাদখিল’ অঙ্কশাস্ত্র;
৬. কিতাবুল বারাহিন ফিল কাদায়া ফি মা স্তামখাস্ত দাওয়ােফালতােম ফি কিতাবিহ;
৭. কিতাবুল ইমতিখরাজ……..;
৮. আল-মাজেস্ত;
৯. Sexagesimal -এর তালিকা গ্রন্থ। এছাড়া ‘জিজ আল সামিল’ নামে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে।
এই মহান মুসলিম বিজ্ঞানী ৯৯৮ খৃস্টাব্দের জুলাই মাসে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন।
2 thoughts on "[পর্ব ৮] ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আবুল ওয়াফা:-ত্রিকোণমিতির মূল স্থপতি]"