আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের সব পর্ব:-
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬
24.আল ফারাবি(অ্যারিস্টটলের পর দর্শনের সেকেন্ড মাস্টার,পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্যের অবস্থান নির্ণয়কারী)
পৃথিবীতে মুসলমানদের উন্নতির জন্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আশীর্বাদ হিসেবে যুগে যুগে যে সকল মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেয় পৃথিবীতে পাঠিয়ে ছিলেন আল ফারাবী তাদের অন্যতম।প্রজ্ঞাবান এই মহান পুরুষ ঐশ্বরিক কৃপা পেয়েছিলেন পরিপূর্ণভাবে।
তার জন্ম তারিখ কত তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। তার জন্ম তারিখের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হল তৎকালীন যুগে কারাে জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না।
যতদূর জানা যায় এ মনীষী ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তুকিস্তানের অন্তর্গত ফারাব’ নামক শহরের নিকটবর্তী আল ওয়াসিজ’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
‘ফারাব’ নামক শহরের নামানুসারে আবু নাসের মােহাম্মদ পরবর্তীতে আল ফারাবী নামে পরিচিত হন। তার পুরো নাম আবু নাসের মােহাম্মদ ইবনে আল-ফারাখ আল ফারাবি।
তার বাবা ছিলেন একজন জেনারেল। ইউরােপে ফারাবির পরিচয় ছিল আল- ফারাবিয়াস নামে।
আল ফারাবি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন জ্ঞান পিপাসু। অজানাকে জানার এবং অজেয়কে জয় করার প্রবল আকাক্ষা ছিল তার হৃদয়ে।
শৈশবে লেখা পড়া করেন ফারাবে এবং বুখারায়। বর্তমান উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্রের একটি বড় ইচ্ছে বুখারা। এরপর তিনি চলে যান বাগদাদে। ৯০১ থেকে৯৪২ খৃস্টাব্দ সুদীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর সময় পরিধিতে তিনি সেখানে লেখাপড়া করেন ও গবেষণায় নিয়ােজিত থাকেন। এই দীর্ঘ সময় পরিধিতে তিনি বেশ কিছু ভাষাও শেখেন।
দর্শন ও ত্রিকোণমিতি ছিল তাঁর জ্ঞানার্জনের প্রধানতম ক্ষেত্র। খুব শিগগিরই তিনি হয়ে ওঠেন প্রথম সারির বিজ্ঞানী ও দার্শনিক।জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ছিলেন তিনি পারদর্শী। তিনি একজন বড় মাপের ভাষাবিদও ছিলেন। তাঁর জ্ঞানান্বেষণে কাজটি ব্যাপৃত ছিল ৬ জন আব্বাসীয় খলিফার শাসনামল জুড়ে। তিনি জ্ঞানার্জনের জন্যে বহু জায়গায় গেছেন। এর মধ্যে মিশরও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তাঁর জীবন উৎসর্গীত ছিল সুফীবাদ ও দর্শনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটানাের লক্ষে। এর ফলে তিনি সৃষ্টি করে যেতে পেরেছেন এক নতুন ভাবনার জগত। পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিয়ে গেছেন নব নব ধারণা। তাই ইবনে সিনার বিজয়ী অগ্রগমনকে করে তুলেছিল সহজতর। শত শত জ্ঞানান্বেষী ও আধ্যাত্মিক পথিক এ পথে চলে নিজেদের করে গেছেন ধন্য। আল-ফারাবি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
আল-ফারাবি এক সময় চলে যান হালাব-এ। হালাব-এর আধুনিক নাম আলেপ্পো। আলেপ্পো হচ্ছে উত্তর সিরিয়ার একটি নগরী। এখানকার অধিবাসীদের বলা হয় আলেপ্পাইন। তখন আলেপ্পোর সম্রাট ছিলেন সাইফ আল-দৌলা।
সম্রাটের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও আলােচনা হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে সম্রাট হয়ে ওঠেন তাঁর পরম ভক্ত। পরম শুভাকাঙ্ক্ষী। ফারাবি হলেন তাঁর সব সময়ের সাথী । ফারাবির খ্যাতি এরই মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর আগে তাঁর জীবন ছিল নানা দুঃখ আর দুর্ভোগ তাপে জর্জরিত। তাঁর দুর্ভোগ আন্দাজ অনুমান করার মতাে নয়। এক সময় তাকে বাগানের মালি হিসেবেও কাজ করতে হয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তিনি কাজী পদে আসীন হন। কিন্তু অল্প সময়েই এ পেশা ছেড়ে শিক্ষকতায় আসেন।
ফারাবি’র পাণ্ডিত্য ছিল সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্র ছিল সুপরিসর। তা বিস্তৃত ছিল বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, সমাজ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত, সঙ্গীত ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত।পদার্থ বিজ্ঞানে তিনিই শূণ্যতার অর্থাৎ,’এম্পটি স্পেস’ এর অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন।
সঙ্গীতে তার অবদান বিস্ময়কর। তিনি বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্ উদ্ভাবন করেন। সিম্ফনি বা সুরের ঐকতান সৃষ্টিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। কিছু প্রজ্ঞা পরিধির পরিচয় মেলে তাঁর লেখা বই কিতাব আল-মিউজিকায়। তিনি নিজে সঙ্গীত জগতের এক প্রবাদ-প্রতিম ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যখন তিনি তাঁর বাদ্যযন্ত্রের তারে হাত দিতেন, তখন ইচ্ছে মতাে সুর তােলে শ্রোতাদের হাসাতে ও কাঁদাতে পারতেন।কিতাব আল মুসিকি আল কবির(সঙ্গীতের মহান গ্রন্থ) তার একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
তাঁর অবদান দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যায় ছিল প্রতিনিধিত্বশীল। তাঁকে বিবেচনা করা হয় নিও প্লেটোনিস্ট বা নব্য প্লেটোবাদী। তবে এ বিবেচনা যথার্থ ছিলাে না। তিনি প্লেটোবাদী ধ্যান-ধারণা ও অ্যারিস্টটলবাদী ধ্যান-ধারণার মধ্যে একটা ভারসাম্য সৃষ্টির প্রয়াসী ছিলেন। এ প্রয়াস সূত্রে তিনি শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি করে গেছেন চিন্তার নতুন ধারা।
সমসাময়িক দুনিয়ায় আল-ফারাবিকে ধরা হতাে ‘সেকেন্ড মাস্টার অব ফিলােসপি’। অ্যারিস্টটল ছিলেন ‘ফাস্স্ট মাস্টার’। ফারাবির জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্র ছিল অ্যারিস্টটলীয় পদার্থ বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও যুক্তিবিদ্যা।
তিনি তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণার ওপর ভিত্তি করে লিখে গেছেন বেশ ক’টি বই।তাকে যথার্থ অর্থেই দর্শন জগতের সেকেন্ড মাস্টার বা ‘আল-মুয়াল্লিম আল-সানি বলা হতাে।
তিনি যুক্তিবিদ্যার শিক্ষণকে দু’ভাগে ভাগ করেন। একটি ভাগ কাজ্জাল বা ধারণা বা আইডিয়া। অন্যটি জুবাত’ বা প্রমাণ। দর্শন শিক্ষণ ও শেখার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন।
সমাজ বিজ্ঞান, মনস্তত্ব ও অধিবিদ্যায় আল-ফারাবির মৌল গবেষণা খুবই অমূল্য। সৃষ্টি রহস্যের আলােক মানুষের কর্মকাণ্ড তিনি বিশ্লেষণ করেছেন যথার্থভাবে।
সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে তার বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘আল আহলে আল- মদিনা আল-ফাজিলা’।
তিনি রাজনীতি বিজ্ঞান, দর্শন, পদার্থ বিদ্যার গভীর জ্ঞান রাজ্যে বিচরণ করে এসব বিষয়ে হয়ে ওঠেন পণ্ডিতসম ব্যক্তিত্ব। রাজনীতি বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক তাঁর বই আলা আহলে আল-মদিনা আল-ফাজিলা'(দর্শন ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান সম্পর্কিত) এক অনন্য সৃষ্টি।
তার লেখা বইগুলাের সবগুলাে এখন আর পাওয়া যায় না। যে মানুষটির ধ্যান-ধারণা প্লেটো ও অ্যারিস্টটলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তার অবদান পুনরুদ্ধার করা যায়নি সে কারণেই। ফলে পাশ্চাত্যের চোখে তিনি এক প্রয়ােজনাতিরিক্ত ।
তার বইয়ের সংখ্যা আজ আন্দাজ অনুমানের বিষয়। কেউ বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ১১৭টি বই লিখে গেছেন। এগুলাের মধ্যে ৪৩টি যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে, ১১টি অধিবিদ্যা বিষয়ে, ৭টি আইনবিদ্যা ও ৭টি রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ে। এছাড়া সঙ্গীত, ওষুধ ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে আছে তাঁর আরও ১৭টি বই। তাঁর সবচেয়ে সেরা বইটি লেখা দর্শন বিষয়ে। বইটির নাম ‘ফুসুস আল-হিকাম’।
প্রাথমিক পাঠ্য বই হিসেবে এটি বহুদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘ দিন অব্যাহতভাবে চালু ছিল। প্রাচ্যে উচ্চ শিক্ষায় ব্যবহার হতাে ফারাবির লেখা কিছু বই। ফারাবি বিজ্ঞানের সবচেয়ে অন্তর্নিহিত নীতিগুলাে নিয়ে আলােচনা করে গেছেন। এ বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বই হচ্ছে “কিতাব আল-উলুম’।
ফারাবির কাছে Theology of Aristotle’-এর একটা মূল কপি ছিল। জনপ্রিয় বিশ্বাস ছিল, এটি এরিস্টটলের লেখা মূল কপি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার ভিন্নরূপ প্রমাণিত হয়। ধারণা করা হয়, এটা ছিল অ-প্লেটোনীয় কোন দার্শনিকের লেখা বই।
খুব সম্ভবত, এটা ছিল ফারাবির নিজেরই কাজ। কয়েক শতাব্দী ধরে ফারাবির তত্ত্বগুলাে দর্শন শাস্ত্রে প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তার অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়ন মুশকিল। রীতিমতাে কঠিন। কারণ তার অবদান এতাে বিশাল যে পরিমাপ করা সহজ কাজ নয়।
বিজ্ঞান সম্পর্কে ও তার রচিত কয়েকটি গ্রন্থ তাকে বিখ্যাত করেছে। তিনি আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। কিন্তু মুসলিম জাতির কল্যাণে তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের যে মৌলিত আবিষ্কার রেখে গেছেন তা চর্চা করলে মুসলমানরা আজও জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি লাভ করতে পারবে।
তিনি কত সালে ইন্তেকাল করেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। যতদূর জানা যান তিনি ৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন।