আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের সব পর্ব:-
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬
29.ছাবেত ইবনে কোরা(স্টাটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা)
ছাবেত ছিলেন নবম শতাব্দীর এক বিস্তীর্ণ বিজ্ঞানী।ছাবেত ইবনে কোরা ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী গণিতবিদ যিনি সংখ্যা তত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং স্ট্যাটিক্সের উপর কাজ করেছিলেন।তিনি আব্বাসীয় খিলাফতের সময় নবম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাগদাদে বাস করেছিলেন ।
তিনি ছিলেন ইসলামের স্বর্ণযুগের একজন গণিতজ্ঞ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অনুবাদক। ছাবেত ইবনে কোরা এলজাব্রা, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছেন। তাকে টলেমি ব্যবস্থা সংস্কারের অগ্রদূত হিসাবে গণ্য করা হয়। তিনি প্রথম √x এর অখণ্ড সংখ্যা গণনা করেন।
এছাড়া তিনি প্রথম অধিবৃত্তের পরিমাণ নির্ধারণ এবং গ্রহণের ক্ষেত্রফল খুঁজে বের করেন। বিজ্ঞানের সব শাখায় ছিল ছাবেতের পদচারণা। তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী ছিলেন তা বলা কঠিন। তার বহুমুখী প্রতিভা স্বীকার করতে গিয়ে ড. সিরিল এলগুড অ্যা মেডিকেল হিস্টরি অব পার্সিয়ার ১২৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘Judging from his recorded works, which are many, and his existing works which are few, it is difficult to say in which branch of learning Sabit excelled.
অর্থাৎ তার তালিকাভুক্ত কর্মের সংখ্যা বহু এবং তার বিদ্যমান কর্মের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। এসব কর্মের ভিত্তিতে বিচার করতে গেলে ছাবেত জ্ঞানের কোন শাখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন তা বলা মুসকিল।
জীবনী
ছাবেত খলিফা আল-মামুনের রাজত্বকালে ৯০১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মেসােপটেমিয়ার অন্তর্গত হাররানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ নাম আবু হাসান ছাবেত ইবনে কোরা ইবনে মারওয়ান আল-হাররানি। সাবিত হারবানের বিত্তশালী এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।
হাররানে জন্মগ্রহণ করায় তিনি আল-হাররানি নামেও পরিচিত ছিলেন। ল্যাটিন ভাষায় তিনি ছাবিত (Thebit), ছাবিথ (Thebith) ও তাবিত (Tebit) নামে পরিচিত।
ছাবেত ইবনে কোরার পূর্বপুরুষ ছিল সাবীয় বংশের লােক। সাবীয়রা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করলেও গ্রহ উপগ্রহের পূজা করতাে। ৬৩৯ সালে মুসলিম শাসনাধীনে আসার পর সাবীয়রা পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
জন্মগতভাবে এ অঞ্চলের লােকদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল। সাবীয় গােত্রে বহু খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল। গ্রীকদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় এ গােত্রের লােকজন ছিল গ্রীক সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত। সেই সূত্রে তারা গ্রীক ভাষাও জানতাে।
মুসলিম শাসন কায়েম হলে সাবীয়রা আরবীভাষীতে রূপান্তরিত হয়। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় তুরস্কে সিরীয় নামে আরেকটি ভাষা ছিল। যা এডেসার পূর্ব আরামাইক উপভাষার উপর ভিত্তি করে ছিল। এই ভাষাটি থাবিত ইবনে কুরার মাতৃভাষা ছিল তবে তিনি গ্রীক এবং আরবী উভয় ক্ষেত্রেই সাবলীল ছিলেন।
প্রথম বয়সে সাবিত বাগদাদ গমন করেন এবং অংক শাস্ত্রের ওপর পড়াশুনা করেন।দেশে ফিরে এসে তিনি প্রথম অর্থের দালালি (মানি চেঞ্জার) ব্যবসা করতে থাকেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার দর্শন প্রচার শুরু করেন।
ব্যবসা সহ্য হলেও তার দর্শনের উদার মতবাদ আত্মীয় স্বজন ও দেশবাসীর সহ্য হলাে না, যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তিনি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন।আদালত তার এ মতবাদ প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে। আদালতের রায় শুনে ছাবেত হাররান থেকে পালিয়ে সুদূর দারার কাছাকাছি ‘কাফার তুসায়’ চলে যান এবং জীবিকার্জনে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন।
এখানেই মােহাম্মদ বিন মুসা বিন শাকিরের সঙ্গে তার দেখা হয়। মােহাম্মদ বিন মুসা গ্রীক পণ্ডিতদের বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাবলীর অনুসন্ধানে বাইজান্টাইন ভ্রমণ করে বাগদাদে ফিরছিলেন। পথে ছাবেতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। প্রথম আলাপেই তার বুদ্ধিমত্তা ও প্রগাঢ় জ্ঞানস্পৃহা দেখে মােহাম্মদ মুসা তাকে সঙ্গে করে বাগদাদে নিয়ে আসেন এবং তাঁর সুপারিশে তিনি তখনকার খলীফা মুতাজিদের রাজকীয় সাহায্য প্রাপ্ত হন।
পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করে মুতাজিদ ছাবেতের প্রতি মনােযােগ দেন এবং তাকে রাজদরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে নিয়ােগ করেন।
তখন থেকে জীবনের অধিকাংশ সময় ছাবেত এখানেই অতিবাহিত করেন। আব্বাসীয় বংশের খলিফা আল-মুতাজিদ ছিলেন তার পৃষ্ঠপােষক।
গ্রীক পাণ্ডুলিপির আরবী অনুবাদ
সেসময় গুরুত্বপূর্ণ সব পান্ডুলিপি গ্রীক ভাষায় ছিল।তাই পাণ্ডুলিপিগুলাে আরবী ভাষায় অনুবাদ করার জন্য যােগ্য লােকদের নিয়ােগ দেয়া হতাে।
ছাবেত গ্রীক ও আরবী উভয় ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন।তাই তাকে অনুবাদক হিসাবে নিযুক্তি দেয়া হয়।
অনুবাদক হিসাবে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রীক পাণ্ডুলিপি অনুবাদ ও সংশােধন করেন। আল-হাজ্জাজ ইউক্লিডের এলিমেন্টস’-এর দু’টি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। কিছু ভগ্নাংশ ছাড়া দু’টি বইয়ের প্রায় সবই খােয়া যায়।
ছাবেতের সমসাময়িক চিকিৎসা বিজ্ঞানী হুনায়ন ইবনে ইসহাক ইউক্লিডের জ্যামিতির তৃতীয় আরবী সংস্করণ অনুবাদ করেন। ছাবেত অনুবাদটি সংশােধন করেন এবং তার সঙ্গে একটি উপক্রমণিকা জুড়ে দেন।
তিনি টলেমির আলমাজেস্টের হুনাইন অনুবাদ সংস্করণ করেন এবং টলেমির ভূগোল বিষয়ক কাজ অনুবাদ করেন।
এছাড়াও তিনি আর্কিমিডিসের আরেকটি কাজ অনুবাদ করেন যেখানে একটি regular heptagon আঁকার পদ্ধতি বলা হয়েছিল,যেটি ২০ শতকে আবিষ্কার হয়েছে।কিন্তু এটার আসল কপি হারিয়ে গেছে।
তিনি বাগদাদে অনুবাদ স্কুলও তৈরি করেছিলেন।
আরব বিশ্বে গ্রীক শিক্ষাগ্রহণের এই শিল্পের কারণেই বাস্তবে অনেক গ্রীক গ্রন্থ,গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞান টিকে আছে। তবে ছাবিতের মতো গণিতবিদরা কেবল গ্রীক জ্ঞানের সংরক্ষক ছিলেন। এছাড়াও ছাবিত ছিলেন এক উজ্জ্বল বিদ্বান, যিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক আবিষ্কার করেছিলেন।
জ্যামিতিতে ছাবেতের অবদান
ছাবেত চিকিৎসক হিসাবে পরিচিত হলেও দর্শন ও অঙ্কশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণায় নিয়ােজিত হন। তাকে আরবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্যামিতিক হিসাবে গণ্য করা হয়।
ইউক্লিডের জ্যামিতি শেখার মধ্য দিয়ে তিনি গণিতজ্ঞ হিসাবে জীবন শুরু করেন। ছাবেত একটি ত্রিভুজের মাধ্যমে পিথাগােরাসের উপপাদ্যের সমাধান দেন।
তিনি পরাবৃত্ত ও কোণকে ত্রিখণ্ডিতকরণ নিয়েও আলােচনা করেছেন। পরাবৃত্ত ও অধিবৃত্তের ওপর ছাবেতের কর্ম অখণ্ড ক্যালকুলাস উদ্ভাবনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
গ্রীকরা জ্যামিতির পরিমাপ নিয়ে আলােচনা করেছিল। তবে তারা গাণিতিক নিয়ম ব্যবহার করার কথা ভাবেনি। ইতিপূর্বে জ্যামিতিক এবং সংখ্যা বহির্ভূত হিসাবে বিবেচিত পরিমাপের গাণিতিক সমাধান দিতে গিয়ে ছাবেত এমন একটি নিয়ম উদ্ভাবন করেন যা সংখ্যা তত্ত্বের পথ প্রশস্ত করে। এ ধারণা ছাবেতের সংখ্যা তত্ত্ব হিসাবে পরিচিত।
ছাবেত গ্রীক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সমকোণী ত্রিভুজের ফলাফলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় অখণ্ড √x গণনা করতে সক্ষম হন।
ম্যাজিক স্কোয়ার, সমরূপী সংখ্যা প্রভৃতি সম্পর্কে তিনি কয়েকটি বই রচনা করেন। ম্যাজিক স্কোয়ার কয়েকটি ভাগে বিভক্ত।
তার মধ্যে সাধারণ, নাসিক, সেমিনাসিক, এসসাসিয়েট প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। নাসিক, সেমিনাসিক প্রভৃতি শব্দের উৎপত্তি ভারতবর্ষে। অনেকে মনে করেন, মুম্বাইয়ের অন্তর্গত নাসিকের কোনাে অঙ্কশাস্ত্রবিদ এসব শব্দ প্রথম প্রচলন করেন। তবে নাসিক, সেমিনাসিক ছাড়া অন্যগুলাের প্রথম উদ্ভব কোথায় ঘটেছিল সে বিষয়ে সঠিক কিছুই জানা যায়নি। খুব সম্ভব চীনে। অনেকের মতে, চীনেই অঙ্কশাস্ত্রের প্রথম উদ্ভব।
ম্যাজিক স্কোয়ার উচ্চাঙ্গের না হলেও গণিতের বিভিন্ন শাখার মধ্যে তাও একটি উল্লেখযােগ্য শাখা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ছাবেত ম্যাজিক স্কোয়ারের একটি স্পষ্ট রূপ দিয়েছিলেন।
আল-খাওয়ারিজমি যেমন বীজগণিতের প্রতিপাদ্য প্রমাণ করার জন্য জ্যামিতি ব্যবহার করেছেন, ছাবেত ঠিক তার উল্টো বীজগণিতের সমস্যাগুলাে জ্যামিতিতে পূর্ণভাবে ব্যবহার করেছেন।
তার আগে অন্য কেউ এভাবে বীজগণিতের সমস্যাকে জ্যামিতির প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে গণ্য করেননি।
জ্যামিতির প্রতি বিশেষভাবে মনােনিবেশ করলেও তিনি বীজগণিতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেননি।
সমসাময়িক বিজ্ঞানী আল-মাহানির তৃতীয় মাত্রার সমীকরণ সমাধানের প্রতি তার মনােযােগ আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি তৃতীয় মাত্রার কয়েকটি সমীকরণ সমাধানের চেষ্টা করেন। এগুলাের মধ্যে একটি ঘনকে দুই ঘনতে বিভক্ত করার উপায় ছিল অন্যতম।
জ্যামিতির সাহায্যে এগুলাের সমাধান ছিল খুবই সুন্দর এবং বিজ্ঞানসম্মত। তবে তার কোনাে সাধারণ সমাধান প্রণালী তিনি স্থির করতে পেরেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। তার এলজাব্রার একটি অংশ প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত। বইটির একটি পরিচ্ছেদে ত্রিমাত্রিক সমীকরণ নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। জ্যামিতির সাহায্যে তার সমাধান করা হয়েছে।
সমীকরণটি ছিল এরকম: x3+6x = 20 বা x3+px = q
এ সমীকরণ সমাধানে তিনি এমন দু’টি ঘন নেয়ার পরামর্শ দেন যাতে তাদের ধারের আয়তক্ষেত্র হয় 2 বা 1/3p এবং তাদের ঘন এর পার্থক্য হয় ২০ (বা q)। তাহলে x হবে দুই ঘন এর ধারের পার্থক্যের সমান। তার জ্যামিতিক উদাহরণ হলাে:
A—————-B—————C
AC একটি সরল রেখা। যদি AC রেখা থেকে CB অংশ কেটে নেয়া যায় তাহলে AB এর ওপরের ঘন AC এবং BC এর ওপরের ঘন-এর পার্থকে্যের চেয়েও কম হবে। তার পরিমাণ হবে AC, BC এবং AB এর ধারের ওপরের ৬টি সমান্তরিকের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রের সমান।
এলজাব্রার ভাষায় (a-b)3 =a3-b3-3ab (a-b)।
এ থেকে x বেরিয়ে যাবে। ঘন দু’টির ধারের দৈর্ঘ্য বের করতে শুধু মাত্র একটি দ্বিমাত্রিক সমীকরণের সমাধান দরকার।
তিনি কণিক, ম্যাজিক স্কোয়ার, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আল ম্যাজেস্ট প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। উপবৃত্তের ঘনফল নির্ণয় করতে গিয়ে সাবিত বিকলন পদ্ধতির আবিষ্কার করেন।
ত্রিকোণমিতি সম্পর্কেও ছাবেত কিছু কিছু আলােচনা করেছিলেন। আল-বাত্তানির হাতে ত্রিকোণমিতির যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় তাঁর সূত্রপাত করেন সাবিত।
ক্যালকুলাসের পথ প্রদর্শক
গণিতের অন্যতম শাখা ক্যালকুলাস বা উচ্চতর গণিতের সঙ্গে ছাবেতের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্যালকুলাসের দু’টি অংশ।
একটি হলাে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস এবং আরেকটি হলাে ইনটেগর্যাল ক্যালকুলাস। শেষােক্ত ক্যালকুলাসে ছাবেতর অবদান বেশি।
পরাবৃত্ত ও অধিবৃত্তের ঘনফল নির্ণয় করতে গিয়ে তিনি আধুনিক ক্যালকুলাসের পথ প্রদর্শন করেন। তার প্রদর্শিত পথ ধরে জার্মান গণিতজ্ঞ গটফ্রিড উইলহেম লিবনিজ এবং ইংরেজ গণিতবিদ ও পদার্থ বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন এগিয়ে যান।
স্টাটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা
ছাবেত ইবনে কোরা হলেন স্টাটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা। স্টাটিক্স হলাে যন্ত্রবিজ্ঞানের একটি শাখা। মেকানিক্সের ওপর ছাবেতের লেখা কিতাব ফিল কারাসতাম’ (দ্য বুক অন দ্য বীম ব্যালেন্স) বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। ক্রিমােনার গেরার্ড ল্যাটিন ভাষায় বইটি অনুবাদ করেন এবং মেকানিক্সের ওপর একটি কর্ম হিসাবে বইটি ইউরােপে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
কিতাব ফিল কারাসতাম-এ ছাবেত লীভারের ইকুয়িলিব্রিয়াম বা ভারসাম্যের নীতি প্রমাণ করেছেন। তিনি দেখান যে, তৃতীয়টির ভারসাম্য রক্ষাকারী দু’টি সমান বােঝা ইকুয়িলিব্রিয়াম ধ্বংস করা ছাড়া মধ্যবর্তী একটি পয়েন্টে স্থাপিত তাদের যােগফল প্রতিস্থাপন করতে পারে। তারপর শ্রেণীকরণ করার পর ছাবেত সমানভাবে বন্টিত বােঝার কাঠামাে বিবেচনা করেন এবং একটি ভারি বীমের ইকুয়িলিব্রিয়ামের শর্ত খুঁজে পান।
গণিতে এমিক্যাবল সংখ্যা উদ্ভাবন
গণিতে ‘এমিক্যাবল’ সংখ্যা উদ্ভাবন ছাবেতের একটি উল্লেখযােগ্য অবদান। বুক অন দ্য ডিটারমিনেশন অব এমিক্যাবল নাম্বার শিরােনামে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, পিথাগােরাস পূর্ণাঙ্গ ও এমিক্যাবল সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তৃতীয় শতাব্দীতে প্রকাশিত পিথাগােরাসের জীবনীতে ল্যাম্বলিসাস প্রথম এ দাবি করেন।
পিথাগােরাসের জীবনীতে তিনি এমিক্যাবল সংখ্যা ২২০ ও ২৮৪ বলে উল্লেখ করেন। ২২০ ও ২৮৪ হলাে সর্বনিন্ম এমিক্যাবল সংখ্যা। এমিক্যাবল সংখ্যা হলাে দু’টি ভিন্ন রাশি বা সংখ্যা। এ দু’টি সংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক হলাে এরকম যে, প্রতিটি সংখ্যার বিভাজকগুলাের যােগফল হবে অন্য সংখ্যাটির সমান। যেমন- ২২০ এর বিভাজক হলাে ১, ২, ৪, ৫, ১০, ১১, ২০, ২২, ৪৪, ৫৫ ও ১১০। এ সংখ্যাগুলাের যােগফল দাঁড়াবে ২৮৪। আবার ২৮৪ এর বিভাজকগুলাে হলাে ১, ২, ৪,৭১ ও ১৪২। এ সংখ্যাগুলাের যােগফল দাঁড়াবে ২২০। এই হলাে এমিক্যাবল সংখ্যার রহস্য। আসলে পিথাগােরাস এ ধরনের সংখ্যা বের করার চেষ্টা করেননি।
ল্যাম্বলিসাসের দাবি পুরােপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তারপর ছাবেত সঠিকভাবে উল্লেখ করেন যে, ইউক্লিড ও নিকোমাচাস পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করেন এবং ইউক্লিড পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা নির্ণয় করার একটি নিয়ম বের করেছেন। তবে তাদের কেউ এমিক্যাবল সংখ্যা নির্ণয়ে কোনাে আগ্রহ দেখাননি।
ইউক্লিড ও নিকোমাচাস উভয়ে বিষয়টি উপেক্ষা করায় তিনি প্রয়ােজনীয় লিমাসের সাহায্যে এমিক্যাবল সংখ্যা বের করে তা প্রমাণ করেন। ৯টি লিমাস বের করার পর ছাবেত তার স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ করেন।ছাবেতের নিয়মে বলা হয়, যদি
p=3x 2n -1-1,
q=3×2n-1,
r=9×22n-1-1
তাহলে n>1 হবে একটি অখণ্ড সংখ্যা এবং p, q ও r হবে প্রাইম নাম্বার। 2n pq এবং 2nr হলাে এক জোড়া এমিক্যাবল সংখ্যা। ছাবেত n=2 এর জন্য (২২০, ২৮৪), n=4 এর জন্য (১৭২৯৬, ১৮৪১৬) এবং n=7 এর জন্য (৯৩৬৩৫৮৪, ৯৪৩৭০৫৬) নির্ধারণ করে। এ ফর্মুলা ছাবেতের সংখ্যা হিসাবে পরিচিত।
অনুবাদকারী হিসাবেও ছাবেত কম যাননি। তিনি এপােলনিয়াসের কণিকের পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম খণ্ড অনুবাদ করেন ও ভাষ্য লিখেন। এছাড়া আর্কিমিডিস, ইউক্লিড, থিওডােসিয়াস ও টলেমির কয়েকটি বইও অনুবাদ করেন। ছাবেত তার একটি বইয়ে অনুপাত গঠন নিয়ে আলােচনা করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি জ্যামিতির পরিমাপে প্রযােজ্য অনুপাতের গাণিতিক সমাধান দিয়েছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তিনি সৌর বছর গণনা, সূর্যের তুঙ্গত্ব নির্ণয়, ছায়া ঘড়ি নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা চালান। এ সকল বিষয়ে তাঁর সংগৃহীত উপায় মৌলিকত্বের দাবিদার।
নাক্ষত্রিক বছরের তিনি যে হিসেবে করেন তা আজও চালু আছে। তখনকার দিনের যন্ত্রপাতির কথা বিবেচনা করলে এটি সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার বলে মনে হয়।
তিনি বাগদাদের মানমন্দিরে দিনের পর দিন গ্রহ নক্ষত্রাদির গতিবিধি নিরীক্ষণ করতেন এবং তার ফলাফল লিখে রাখতেন। পরে সেসব ফলাফল থেকে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সৌরবর্ষের দৈর্ঘ্য, সূর্যের দূরত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে আলােচনা করতেন।
তিনি যেসব তথ্য রেখে গেছেন সেগুলাে আজো তার অমর কীর্তি ঘােষণা করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে তার গণনায় একটি ভুল ছিল। কিন্তু যােড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এ ভুল সংশােধন করা হয়নি। ছাবেতের পরবর্তী বিজ্ঞানীরা এমনকি কোপার্নিকাস পর্যন্ত এ ভুলকেই সঠিক বলে মনে নিয়েছিলেন।
তার নির্ণীত ক্রান্তিবৃত্তের তীর্যকতার মান হলাে ২৩ ডিগ্রি ৩৩৩২। বিষুবীয় বিন্দুগুলাে স্থির না থাকায় বিষুব রেখার পরিবর্তে নক্ষত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি সূর্যের গতি বের করার প্রস্তাব করেন। তার নাক্ষত্রিক বছরের পরিমাপ বর্তমান পরিমাপের প্রায় কাছাকাছি। বােসাে (Bossaut) অবশ্য তার নির্ণীত ফলকে একটি আকস্মিক ঘটনা বলে ধরে নিয়েছিলেন। তিনি তার ধারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, আরবরা সাধারণত টলেমিকে অনুসরণ করতেন। টলেমির এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনাে ধারণা ছিল না।
ছাবেতেরও নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ ধারণা ছিল না। হিপােক্রেটস এবং টলেমির মতাে তিনিও মনে করতেন, গ্রহগুলাে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় এবং পূর্বস্থানে ফিরে আসে। আবার আগের মতাে চলতে থাকে এবং পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে এগুলাে পর্যায়ক্রমে যাতায়াত করে। এ থেকেই ‘ট্রেপিডেশন (Trepidation) উপস্থিত হয়। গ্রহ উপগ্রহের গতি সম্পর্কে টলেমির মতবাদকে উন্নত ও সংশােধিত করার জন্য বিষুবরেখা ও আয়নমণ্ডলের সংযােগস্থলের (কাল্পনিক) কম্পনকে প্রমাণ করতে তিনি টলেমির অষ্টম গােলকের সঙ্গে অন্য একটি গােলক সংযােগ করে দেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যবহৃত যন্ত্র গােলাকার এস্ট্রোল্যাব তৈরিতে তিনি অবদান রেখেছিলেন। ইরেশনাল ট্রান্সভারস্যাল ফিগার (Irrational transversal figure ) বা অখণ্ড আড়াআড়ি সংখ্যা সম্পর্কে ছাবেতের কয়েকটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। অন্যান্য বইয়ের মতাে এসব বইয়ে ইউক্লিড এবং প্লেটোর অনেক নিয়ম পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের প্রবর্তিত কয়েকটি নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ছাবেত বহু বই লিখলেও টিকে আছে মাত্র ৮টি। তিনি কনসারনিং দ্য মােশন অব দি এইটথ স্কিয়ার’- এ সূর্যের দূরত্ব, সৌরবর্ষ, সূর্যঘড়ি বা ছায়াঘড়ি এবং গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করেছেন।
তুলাদণ্ডের ব্যবহার
ফলিত জ্যোতির্বিজ্ঞানে সাবিতের কাজ ছিল অতুলনীয়। যন্ত্রপাতি নির্মাণে ও এর উন্নয়নে তিনি মৌলিক প্রতিভার ছাপ রেখে যান। ইতােপূর্বে তুলাদণ্ডের নির্মাণ ও এর ব্যবহার সম্পর্কে কেউ কোন কাজ করেন নাই। তুলাদণ্ডের সূক্ষ্মতা বিচারে সাবিত অনেক কাজ করেন। এ বিষয়ে তিনি একটি গ্রন্থও রচনা করেন। তার বইটির নাম ‘ কিতাব ফিল কারাসতান’। বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আরবী বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ।
এ বইয়ে প্রথম অসম বাহু বিশিষ্ট তুলাদণ্ড নিয়ে আলােচনা করা হয়। যে সময় ছাবেত ইবনে কোরা তুলাদণ্ড নিয়ে বই লিখছিলেন সে সময় বানু মুসা ভ্রাতৃত্রয়ও একই বিষয়ে বই লিখেছিলেন।
ক্রিমােনার গেরার্ড ছাবেতের বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। ল্যাটিন ভাষায় বইটির নাম দেয়া হয় লাইবার ক্যারাসটনিস সায়ার ডেসটারবারা (Liber carastonis sire destarbera)। গেরার্ড এবং জোহানেস ছাবেতের অনেক বই ল্যাটিনে অনুবাদ করেন।
ছাবেতের প্রণীত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক বই গালেনের বইয়ের অনুবাদ। তবে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা পেশার মহত্ত্ব, বসন্ত, হাম এবং পাখির এনাটমি সম্পর্কে তিনি মৌলিক রচনা করেছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানী বাহাউদৌলা তার খােলাসাতুল তাজাবীর-এর বহু জায়গায় ছাবেতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ছাবেতের আল-
জাখিরা সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। ইউরােপে বইটি সমাদৃত হয়েছিল।
রচনাবলী
ছাবেত ইবনে কোরা বহু বইপত্র লিখেছেন। সেগুলাের মধ্যে ১৮৭টি বইয়ের নাম জানা গেছে। নিচে কয়েকটির নাম দেয়া হলাে:
(১) ইখতিয়ার কিতাবু মা বাদেল তাবিয়াত
(২) মাসায়েলাতুল মাশুকাত
(৩) কিতাবু ফি আগালিতুস সুফসতাইন
(৪) কিতাবু ফি মারাতিবুল উলুম
(৫) কিতাবু ফির রাদ্দে আলা মান কালা ইন্নান নাফসা মিযাজ
(৬) জাওয়ামিউ কিতাবুল আদবিয়াতুল মুফরেদাত লেজালিনুস
(৭) জাওয়ামিউ কিতাবুল মাররাতেস সুদা লেজালিনুস
(৮) জাওয়ামিউ কিতাবু সুওয়েল মিযাজ আল-মুখাতেলাফ লেজালিনুস
(৯) জাওয়ামিউ কিতাবুল আমরাজিল হাদাত লেজালিনুস
(১০) জাওয়ামিউ কিতাবুল কাছরাত লেজালিনুস
সম্মান
জ্যোতির্বিজ্ঞানে ছাবেত ইবনে কোরার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩৫ সালে চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছে। ২২ দশমিক শূন্য এস দ্রাঘিমাংশ এবং ৪ দশমিক শূন্য অক্ষাংশে এ গহ্বরের ব্যাস ৫৬ দশমিক ০৫ কিলােমিটার।
মৃত্যু
জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি জন্মভূমিতে ফিরে যান। শেষ দিনগুলাে তিনি হাররানেই কাটান। ৯০১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে বাগদাদে তিনি ইন্তেকাল করেন।ছাবেতের পুত্র সিনান ইবনে ছাবেত এবং তার নাতি ইব্রাহিম ইবনে সিনান ছাবেত উভয়েই ছিলেন খ্যাতনামা পণ্ডিত। গণিতে বিরাট অবদান রাখলেও তাদের দু’জনের কেউ ছাবেত ইবনে কোরার কাছাকাছি পৌছতে পারেননি।