আসসালামু আলাইকুম

আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।

আমার আগের সব পর্ব:-

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬

[পর্ব ৭] ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[নাসির আল দীন আল তুসি:-ত্রিকোণমিতির স্রষ্টা,জিজ-ইলখানি উপাত্তের উদ্ভাবক]

[পর্ব ৮] ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আবুল ওয়াফা:-ত্রিকোণমিতির মূল স্থপতি]

[পর্ব ৯]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আবু মারওয়ান/ইবনে জহুর:-পরভূক জীবাণু বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা,পরীক্ষামূলক সার্জারির জনক, পরীক্ষামূলক শারীরবৃত্তীয়, মানুষের ব্যবচ্ছেদ, অটোপস এর অগ্রদূত]

[পর্ব ১০]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল মাওয়ার্দি:-বিশুদ্ধতম গণতন্ত্রের প্রবক্তা]

[পর্ব ১১]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল জাজারি:-মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ]

[পর্ব১২]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আবুল কাসিম আল জাহারাবী:-অপারেটিভ/আধুনিক সার্জারীর জনক]

[পর্ব১৩]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আব্বাস ইবনে ফিরনাস:-বিমানের জনক,প্রথম যিনি উড়েছিলেন আকাশে]

[পর্ব ১৪]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল-কিন্দি:-ফার্মাকোলজির অগ্রদূত, পেরিপ্যাটেটিক দর্শনের জনক,সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধারকারী,সাইকোথেরাপি ও সংগীত থেরাপির অগ্রদূত]

[পর্ব ১৫]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[ফাতিমা আল ফিহরি:-বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে নারী]

[পর্ব ১৬]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল-খৈয়াম:-বাইনমিয়েল থিওরেমের প্রথম আবিষ্কারক,এনালিটিক্যাল জ্যামিতির জনক]

পর্ব ১৭]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[জাকারিয়া আল রাযি:-আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাণপুরুষ]

[পর্ব ১৮]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল ফারাবি:-অ্যারিস্টটলের পর দর্শনের সেকেন্ড মাস্টার,পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্যের অবস্থান নির্ণয়কারী]

25.আল জারকালি(সূর্যের সর্বোচ্চ উচ্চতার গতি প্রমাণকারী)

আল জারকালি হলেন স্পেনের একজন মুসলিম ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী। তার পূর্ণ নাম আবু ইসহাক ইব্রাহিম ইবনে ইয়াহিয়া আল-নাকাশ আল-জারকালি। সংক্ষেপে তিনি ‘আল-জারকালি হিসাবে পরিচিত। তাঁর নাম পাশ্চাত্য গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত হয়েছে “মারজাকেল” নামে।

ঐতিহাসিকরা ধারণা করছেন, তার নামের শেষাংশের সঠিক উচ্চারণ হওয়া উচিত আল-জারকাল্লা। ল্যাটিন ভাষায় তিনি আরজাচেল’ (Arzachel) নামে পরিচিত।

জারকালি মুসলিম স্পেনের টলেডাের অদূরে একটি গ্রামে ১০২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষভাবে প্রতিভাবান ছিলেন । তাঁর বিস্তৃত অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান তাকে শেষ পর্যন্ত তাঁর সময়ের শীর্ষস্থানীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী করে তুলেছিল । আল-জারকালিও একজন উদ্ভাবক ছিলেন এবং তাঁর রচনাগুলি টলেডোকে আল-আন্দালুসের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল।

তবে জারকালি নিরক্ষর থেকে পন্ডিত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। টলেডাে ছিল তখনকার টাইফার রাজধানী। মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মিলেমিশে বাস করার জন্য টলেডাের খ্যাতি ছিল। আল-জারকালি একজন ধাতু শিল্পী হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ কাজে বিশেষ যােগ্যতার জন্য তার উপনাম ছিল ‘আল-নাকাশ’। আরবীতে আল-নাকাশ শব্দের মানে হলাে ‘ধাতু খােদাইকারী। ধাতু শিল্পী হিসাবে তিনি কাজী সৈয়দ আল-আন্দালুসির অধীনে চাকরিতে নিয়ােজিত হন।

১০৬০ সালে স্পেনে ইয়াহিয়া আবি ইবনে মনসুরের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয়। জারকালি তার গবেষণার জন্য প্রয়ােজনীয় জটিল যন্ত্রপাতি নির্মাণ করতেন। দ্রুত তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মর্যাদাপূর্ণ একটি গ্রুপের জন্যও যন্ত্রপাতি তৈরি করতে থাকেন। এসব জ্যোতির্বিজ্ঞানী তার অসাধারণ মেধা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হন এবং তার প্রতি তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তিনি তখন এসব পন্ডিতকে জানান যে, তার বিদ্যা বুদ্ধি অত্যন্ত সামান্য। তিনি কখনাে বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেননি। এমনকি কখনাে বই স্পর্শ করেননি। তার এ জবাব শুনে পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং অধ্যয়ন করতে বাধ্য করেন। পণ্ডিত ব্যক্তিদের গ্রুপ তাকে প্রয়ােজনীয় বই সংগ্রহ করে দেন।


টলেডাের বিভিন্ন মক্তব্যে দু’বছর শিক্ষা লাভ শেষে ১০৬২ সালে জারকালি পণ্ডিতদের সেই গ্রুপের সদস্য মনােনীত হন। শিগগির তিনি এ গ্রুপের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। পরবর্তী বছরগুলােয় তিনি তার নিজস্ব যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করতে শুরু করেন। অন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুরােধ করলে তিনি তাদের জন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে দিতেন। জারকালি এত অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন যে, তিনি তার শিক্ষকদের শিক্ষা দিতে থাকেন। এসব বিদ্বান ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করছিলেন। গ্রহ, নক্ষত্র এবং চন্দ্র ও সূর্যের দূরত্ব সম্পর্কে জারকালির গণনা তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করতেন।

পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি কুরতুবাতেই অবস্থান করেছিলেন । এরপরে তিনি তালিতা (টলেডো) চলে যান যেখানে তিনি এর সুলতান আল-মামুনের সেবায় প্রবেশ করেন।

তাঁর কাজটি ছিল আল-মামুনের জ্যোতির্বিদদের জন্য উপকরণ তৈরি করা, যারা জ্যোতির্বিদ্যায় একটি বড় গবেষণা প্রকল্পে নিযুক্ত ছিলেন।

আল-জারকালি দিন ও রাতের সময় এবং চান্দ্র মাসের দিন নির্ধারণে সক্ষম একটি জলঘড়ি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি টলেডাে ঘড়ি নামে পরিচিত একটি বিখ্যাত জলঘড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কবি মুসা ইবনে এজরা ঘড়িটির উদ্দেশ্যে তার একটি কবিতা উৎসর্গ করেন। কবিতার প্রথম পংক্তিতে তিনি টলেডাের ঘড়িকে জারকালির বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসাবে মন্তব্য করেছিলেন।

কাস্টিলিয়ান অনুবাদে আল-জহুরি ঘড়িটির বর্ণনা দিয়েছেন। ১১৩৫ সাল পর্যন্ত ঘড়িটি চালু ছিল। খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফনসাে ঘড়িটি দেখতে পান এবং কিভাবে তা কাজ করে তা জানার চেষ্টা করেন। তারপর তিনি হামিস ইবনে জাবারাকে ঘড়িটি খুলে নেয়ার নির্দেশ দেন। ঘড়িটি খুলে ফেলার পর আর কেউ তা জোড়া লাগাতে পারেনি।

ঘড়িটিতে চান্দ্র মাসের নির্ভুল বর্ণনা ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে টলেডাের জলঘড়ির আদলে ইউরােপে ঘড়ি নির্মাণ করা একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল। জারকালির ঘড়িতে পানির দুটি উন্মুক্ত পাত্র ছিল। চাদের হ্রাস বৃদ্ধির সঙ্গে পানির এ দুটি পাত্র খালি অথবা পূর্ণ হতাে। দিগন্তে যে মুহূর্তে নয়া চাদ উদিত হতাে ঠিক তখন ভূমির নিচে প্রােথিত পাইপের সাহায্যে পানির পাত্র দু’টিতে প্রবাহ শুরু হতাে।

প্রথম সাত দিন ও সাত রাতে পানির পাত্র দুটি অর্ধেক পূর্ণ হতাে এবং পরবর্তী সাত দিন ও সাত রাতে বাকি অর্ধেক পূর্ণ হতাে। এসময় পূর্ণিমা শুরু হতাে। চান্দ্র মাসের পনের দিনের মাথায় দিবাগত রাত থেকে পাত্র দু’টি খালি হতে শুরু করতাে। কৃষ্ণ পক্ষের চাঁদের উনত্রিশতম রাতে পাত্রে এক ফোটা পানিও অবশিষ্ট থাকতাে না।

১০৬০ সালে জারকালি জ্যোতির্বিজ্ঞানে কিভাবে জটিল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় তার বর্ণনা দিয়ে আল-সাফিহা আল-জারকালিয়া শিরােনামে ২৯টি গ্রহের তালিকা সম্বলিত একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি সূর্যের গতি নিরীক্ষণে উন্নতমানের এস্ট্রোল্যাব তৈরি করেন। তার তৈরি এস্ট্রোল্যাবের নাম ছিল ‘বাের্ড জারকালি।

জারকালি উদ্ভাবিত এস্ট্রোল্যাবের প্রতি ইউরােপের গভীর আগ্রহ জন্ম নেয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরােপে যন্ত্রটি এস্ট্রোল্যাব জারকালি নামে চালু করা হয়।

১০৮০ সালে জারকালি কালবালাযাদার (রেগুলাস) দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করেন। ১০৮৭ সালে তিনি তার জীবনে শেষবার পর্যবেক্ষণ চালান। জারকালি ছিলেন মূলত জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী। কর্ডোভায় তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তাকে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে সহায়তা করে।

জারকালি গ্রীক বিজ্ঞানীদের গণনাগুলাে সংশােধন করে প্রমাণ করেন, মুসলিম বিজ্ঞান গ্রীক বিজ্ঞানের অনুলিপি নয়। তিনি ভৌগােলিক উপাত্ত বিশেষ করে ভূমধ্যসাগর সম্পর্কে টলেমির গণনা সংশােধন করেন। টলেমির মতে, ভূমধ্যসাগরের দৈর্ঘ্য ৬৩ ডিগ্রি এবং আল-খাওয়ারিজমির মতে, ৫০ ডিগ্রি। জারকালি তার সৌর বর্ষ বিষয়ক গ্রন্থ ট্রাটাডাে রেলেটিভাে আল-মােভাইমেন্টো ডি লাস ইট্রেলাস ফিজাস’ (Tratado relativo al-moviemento de las etrellas fijas)-এ হিসাব করে বের করেন যে, এ সাগরের দ্রাঘিমার দৈর্ঘ্য বা মান ৪২ ডিগ্রি। একই গ্রন্থে তিনি স্থির গ্রহের ভিত্তিতে প্রথম সূর্যের সর্বোচ্চ উচ্চতা বা অপভূর (Solar Apogee) গতি প্রমাণ করেন। তিনি অপভূর গতির হার প্রতি বছর ১২.৪ সেকেন্ড পরিমাপ করেন। আধুনিক পরিমাপ হলাে ১১.৮ সেকেন্ড। তার পরিমাপ আধুনিক পরিমাপের অত্যন্ত কাছাকাছি।

জারকালি সূর্যের অপভূর দ্রাঘিমাংশের মান ৭৭ ডিগ্রি ৫ নির্ধারণ করেন। তিনি এ উপসংহারে পৌছান যে, ক্রান্তিবৃত্তের তীর্যকতা ২৩ ডিগ্রি ৩৩ এবং ২৩ ডিগ্রি ৫৩-এর মধ্যে ঘুরছে।

জারকালি বুধ গ্রহ সম্পর্কে টলেমির আরেকটি ভুল সংশােধন করেন। টলেমির জটিল মডেলে বলা হয়েছিল, বুধের ডিফারেন্টের কেন্দ্র একটি দ্বিতীয় এপিসাইকেল বা ক্ষুদ্রতর বৃত্তের ভেতর ঘুরছে। কিন্তু জারকালি বলেন, দ্বিতীয় এপিসাইকেল কোনাে বৃত্ত নয়। বরং তা প্রায় গােলাকার এবং একটি ফলের বীচির মতাে।

সৌরজগৎ সংক্রান্ত জারকালির মডেলে বলা হয়, সূর্যের ডিফারেন্টের কেন্দ্র একটি ক্ষুদ্র ও ধীর গতিতে আবর্তনশীল বৃত্তের ভেতর ঘুরছে। তার এ মডেল নিয়ে ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে ভার্দুনের বার্নার্ড এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে জার্মান গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী রিগিওমন্টানাস এবং অস্ট্রীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ ভন পিয়ুরবাচ আলােচনা করেন। ষােড়শ শতাব্দীতে পােলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপানিকাস তার ‘ডি রেভলিউশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিয়াম’ (De Revolutionibus Orbium coelestium)-এ জারকালির মডেল ব্যবহার করেন এবং এস্ট্রোল্যাব সংক্রান্ত গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যাপকভাবে তার সহায়তা গ্রহণ করেন।এই বইয়ে নিকোলাস কোপারনিকাস আল-জারাকালি ও আল-বাত্তানির রচনা উদ্ধৃত করেছেন ।

তিনি রেগুলাসের দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করেছিলেন।sine, cosines, versed sines, secants and tangents এর উন্নত ত্রিকোণমিতিক সারণী উপস্থাপন করেছেন।এছাড়াও তিনি ১৩.১৩ “এবং ১৩.৫” এর মধ্যে গ্রহণের ঘনত্বের গণনা করেছেন।

আল-জারকালি শুধু তত্ত্বগতভাবে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন একজন আবিষ্কারক। তার আবিষ্কার ও কর্ম টলেডােকে আল-আন্দালুসের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত করে। জারকালি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক এস্ট্রোল্যাব যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। তার এ যন্ত্র ছিল সবচেয়ে আধুনিক ও নির্ভুল।

এ এস্ট্রোল্যাব যন্ত্রটি বেশ কয়েকটি কাজে ব্যবহার করা যেতাে। সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক অক্ষাংশ নির্ধারণে বিষুব রেখা, অয়নান্ত বৃত্ত ও দিগন্তের নকশাসহ প্ল্যানিসফেয়ার এস্ট্রোল্যাবের সন্মুখভাগে রাশিচক্রের একটি বৃত্ত ও পাত (সাফিয়া অথবা আজাফা) ছিল। এ যন্ত্রের সাহায্যে বৃত্তাকার জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়া সম্ভব হয় এবং দিনের সময় নির্ধারণ করা হয়।


তিনি আরেক ধরনের এস্ট্রোল্যাব যন্ত্রও তৈরি করেন। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি ইউরােপে সাফিয়া নামে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিল। তার সংশােধিত এস্ট্রোল্যাব সূর্যের গতি পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হতাে। জারকালির যন্ত্রপাতিগুলাে ছিল খুবই পরিচিত।এটি নক্ষত্রের উচ্চতা এবং অবস্থান সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হতো। এই ডিভাইসের বিবরণ হিব্রু এবং লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।

১৫৩৪ সালে নুরেমবার্গের জোহান স্কোনার এসব যন্ত্রপাতির বিবরণ সম্বলিত জারকালির একটি বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন।

জারকালির ৭টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার প্রথম গ্রন্থটির নাম টেবলস অব টলেডাে (Tables of Toledo) বা টলেডাের তালিকা। বইটির মূল আরবী সংস্করণ হারিয়ে গেলেও দুটি ল্যাটিন অনুবাদ টিকে রয়েছে।

প্রথম অনুবাদ কর্মটি হলাে ক্রিমােনার গেরার্ডের এবং দ্বিতীয় অনুবাদ কর্মটি সেভিলের জনের। জনের অনুবাদ গেরার্ডের চেয়ে ছােট। টলেডাে টেবলস’ ল্যাটিন বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১১৪০ সালে টলেডাে টেবলস’ অবলম্বনে মার্সেলিস টেবলস’ রচনা করা হয়। দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ গ্রন্থটি গােটা ইউরােপে ছড়িয়ে পড়ে। জারকালি একটি আলমানাক প্রণয়ন করেছিলেন। এ আলমানাকে বহু তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব তালিকা দেখে যে কেউ কপটিক, রােমান, চান্দ্র ও পার্সী মাসের দিন তারিখ খুঁজে বের করতে পারতাে। অন্যান্য তালিকায় গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান প্রদর্শন করা হয়।

জারকালির আলমানাকে ১০৮৮ থেকে ১০৯২ সাল পর্যন্ত চারটি সৌর বর্ষে সূর্যের সত্যিকার দৈনিক অবস্থান এবং ৮ বছর সময়ে প্রতি পাঁচ বা দশ দিনে পাঁচটি গ্রহের সত্যিকার অবস্থান নির্দেশ করা হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রিমানার গেরার্ড জারকালির গ্রন্থটি ল্যাটিনে অনুবাদ করেন এবং এ গ্রন্থ খ্রিস্টান ইউরােপে গণিতভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুনর্জন্ম দেয়। আল-জারকালি প্রণীত ‘আল-সাফিহা আল-জারকালিয়া’ (Azafea) একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা।

জারকালির ট্রাটাডাে রিলেটিভাে আল-মােভাইমেন্টো ডি লাস ইট্রেলাস ফিজাস গ্রন্থটি কেবলমাত্র স্যামুয়েল বেন ইয়াহুদার একটি হিব্রু অনুবাদের মধ্য দিয়ে টিকে রয়েছে। ২৫ বছরের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বইটি লিখা হয়।

১০৭৮ সালের আগে ট্রাটাডাে’র একটি খসড়া টলেডাের শাসক আল-মামুনকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। খসড়াটির নাম ছিল আজাফিয়া মামুনিয়া’। এ বইটি দশম আলফনসাের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তবে আল-মুতামিদ ইবনে আব্বাদের নামে উৎসর্গীকৃত আজা পিয়া আব্বাদিয়া’ পরবর্তীকালে দুটি সংস্করণে প্রকাশিত হয়। বৃহৎ সংস্করণে ছিল এক শ অধ্যায়। দশম আলফনসাের দরবারে কাস্টিলিয়ান ভাষায় বইটির অনুবাদ করা হয়। ল্যাটিন বিশ্বে বইটি সামান্য প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। ৬০ অধ্যায়ের দ্বিতীয় সংস্করণটি জ্যাকব ইবনে তিব্বনের মাধ্যমে অন্য চিন্তাবিদের কাছে পৌছে। জারকালি তার ট্রাটাডাে’র মাধ্যমে গাণিতিকভাবে ট্রেপিডেশন থিওরি (Trepidation theory) প্র করার চেষ্টা করেছেন। ট্রেপিডেশন থিওরি অনুসারে স্থির গ্রহগুলাের গােলকের গতি একটি সরল রেখার গতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

জারকালি তিনটি মডেল অনুসারে এ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। বইটির একটি অনুচ্ছেদে ত্রিকোণমতি নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে সাইন, কোসাইন, সিকান্ট ও টানজেন্টের কয়েকটি তালিকা স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটি ১১৫৪ সালে পাতিয়ার ইতালীয় জন, ১২৯৬ সালে উইলিয়াম ডি সেন্ট ক্লাউড ল্যাটিন এবং ১৩০১ সালে জ্যাকব ইবনে তিব্বন হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করেন। এছাড়া পর্তুগীজ, কাটালান ও কাস্টিলিয়ান ভাষায়ও গ্রন্থটি অনুবাদ করা হয়। ফার মাউন্টপিলারের একজন ইহুদী জারকালির রচিত আল-সাফিহা আল-জা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। জারকালি টলেমির মডেলের এপিসাইকে করে গ্রহগুলাের অবস্থান পরিমাপে ইকুয়াটরিয়াম’ (Equatorium) নামে একটি যন্ত্র নির্মাণে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে রাজা দশম আলফনসাের নির্দেশে এ দু’টি গ্রন্থ ‘লাইব্রোস ডি লাস লামিনাস ডি লস ভি প্লানেটাস’ (Libros de las laminas de los vii planetas) শিরােনামে স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়। রিগিওমন্টানাস জারকালির এস্ট্রোল্যাবের কার্যকারিতার বিবরণ প্রকাশ করার জন্য তার একটি বই অনুবাদ করেন।

আল-জারকালি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তার টলেডাে টেবলস খ্রিস্টান ইউরোপে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। টলেডাে টেবলসে রাইট এসেনশন্স, চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহের ইকুয়েশন, লম্বন, প্রহণ, গ্রহের অন্ত, থিওরি অব ট্রেপিডেশন, একশেসন ও রেসিশন ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। জারকালির পরিমাপের ভিত্তিতে পরবর্তীতে ইউরােপের বিভিন্ন স্থানের তালিকা করা হয়। তার তালিকার ভিত্তিতে প্রথম মার্সেলিসের রেমন্ড একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করেন।

ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে অস্ট্রীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী লিওপােন্ড ‘কম্পাইলেশিও ডি এস্ট্রোনাম সায়েনশিয়া (Compilatio de astronum scientia) শিরােনামে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১০ খণ্ডে বিভক্ত এ বইটি লিখার জন্য লিওপােন্ড জারকালির কাছে বহুলাংশে ঋণী। খ্রিস্টান রাজা দশম আলফনসাে জারকালির গ্রন্থ অনুসরণে ‘টেবলাস আলফনসিনাস’ (Tablas alfonsinas) শিরােনামে একটি গ্রন্থ লিখেন। ১১৪৯ সালে চেস্টারের রবার্টের একটি গ্রন্থ সংকলিত হয়। এ বইটি তিনি লিখেছিলেন আল- জারকালির জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক তালিকা অবলম্বনে।

জারকালির গ্রন্থাবলী ইবনে বাজ্জাহ, ইবনে তােফায়েল, ইবনে রুশদ, ইবনে আল- কামাদ, ইবনে আল-হাইম আল-ইশবিলি, আবু হাসান আল-মারাকাশি, ইবনে আল- বান্না ও নূরুদ্দিন আল-বিক্ৰজির মতাে মুসলিম বিজ্ঞানীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তার গ্রন্থ ষােড়শ এমনকি সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরােপে মুদ্রিত হয়। ষােড়শ শতাব্দীতে অভিযাত্রীরা অক্ষাংশ নির্ধারণে ইউরােপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আব্রাহাম যাকুটের সৌর ডেক্লিনেশন তালিকা ব্যবহার করতেন। এই আব্রাহাম যাকুট গ্রহ, নক্ষত্র ও সৌরমণ্ডলীর গতি সম্পর্কে জারকালিকে অনুসরণ করেছেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে আল-জারকালির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩৫ সালে তার নামে চাঁদের একটি গহ্বরের(Arzachel) নামকরণ করা হয়। ১৮ দশমিক ২ এস দ্রাঘিমাংশ এবং এক দশমিক ৯ ডব্লিউ অক্ষাংশে আরজাচেল গহ্বরের দৈর্ঘ্য ৯৬ দশমিক শূন্য পাঁচ কিলােমিটার।

তিনি 1087 খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

2 thoughts on "[পর্ব ১৯]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল জারকালি:-সূর্যের সর্বোচ্চ উচ্চতার গতি প্রমাণকারী]"

    1. Abir Ahsan Author Post Creator says:
      thanks

Leave a Reply