আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের সব পর্ব:-
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬
28.আল বালখি(যিনি সর্বপ্রথম দেহ ও আত্মা সম্পর্কিত রোগসমূহকে সফলভাবে আলোচনা করেছিলেন)
ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয় ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়কালে ইসলাম ধর্মের নবজাগরণ ঘটেছিল। শিল্প ও সৃজনশীলতা থেকে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সমস্ত ক্ষেত্রেই তখন নবজাগরণ ঘটেছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে, ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দতে খলিফা হারুণ অাল রশিদের রাজত্বকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই নবজাগরণ শুরু। এই নবজাগরণ ইসলামকে প্রভূত বিদ্বান, বহু-বিদ্বজন, চিকিৎসক , বহুভাষাবিদ প্রভৃতি উপহার দিয়েছিল।
আবু জায়েদ আল বালখি তাঁদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন।
নবম শতাব্দীতে, চিকিৎসক আল-বালখি বলেছিলেন যে সুস্বাস্থ্য উপভোগ করার জন্য শরীর এবং আত্মার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার, যখন উভয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা অসুস্থতার কারণ হতে পারে। তিনি উদ্বেগ এবং হতাশার চিকিত্সার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণাগুলি এবং Cognitive therapy এর ব্যবহারও চালু করেছিলেন।
এছাড়াও তিনি ভূগোল, চিকিৎসাশাস্ত্র , ফিলোসফি, থিওলজি, রাজনীতি, ব্যাকরণ, সাহিত্য ও জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর ভূয়সী বুৎপত্তি ছিল।তিনি দার্শনিক আল-কিন্দির শিষ্য ছিলেন
৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ পারস্যের বলখ প্রদেশের শামিসিতিয়ান গ্রামে তাঁর জন্ম। বর্তমানে গ্রামটি আফগানিস্তানের অন্তর্গত।তার পুরো নাম আবু যায়েদ আহমেদ ইবনে সাহল আল বালখী।
বালখির শৈশব নিয়ে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। কেবল তাঁর জন্মস্থান ও পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা সম্পর্কে জানা যায়। তবে তাঁর কৈশোর ও তৎকালীন পড়াশুনো নিয়ে বিশদে জানা যায়। কিশোর বালখি বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের নানা বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন।
তাঁর জ্ঞানচর্চার যে সামান্য অংশ আমরা জানতে পারি তার মধ্যে অন্যতম হল ভৌগলিক মানচিত্র ব্যবস্থা এবং অাধ্যাত্মবাদ সম্পর্কিত তাঁর কিছু কিছু কাজ। দুটি বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ছিল অনবদ্য।
তিনি সর্বপ্রথম দেহ ও আত্মা সম্পর্কিত রোগসমূহকে সফলভাবে আলোচনা করেছিলেন। তিনি আধ্যাত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের বর্ণনা দিতে আল-তিব্ব আল-রুহানী শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এবং মানসিক ওষুধের বর্ণনা দেওয়ার জন্য টিব্ব-আল-কালব শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন ।
তিনি শারীরিক অসুস্থতার উপর অত্যধিক জোর দেওয়া এবং মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক অসুস্থতাকে অবহেলা করার জন্য বহু মেডিকেল চিকিৎসকের সমালোচনা করেছিলেন।রোগীদের বিষয়ে যুক্তি দিয়েছিলেন যে “যেহেতু মানুষের নির্মাণ তার আত্মা এবং তার দেহ উভয় থেকেই, সুতরাং, আত্মা এবং দেহের ইস্ততিবাক [ অন্তর্নিমিত বা জড়ানো ] ব্যতীত মানুষের অস্তিত্ব সুস্থ হতে পারে না।”
তিনি আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে “যদি শরীর অসুস্থ হয়, নাফস [মানসিকতা] এর অনেক চেতনা/বোধশক্তি এবং ব্যাপক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং জীবনের আকাঙ্ক্ষিত দিনগুলি উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়” এবং “যদি নাফস অসুস্থ হয়, তখন দেহ আনন্দ উপভোগ করার প্রাকৃতিক ক্ষমতাটি হারাবে এবং তার জীবনটি ব্যথিত ও বিড়ম্বিত হয়ে উঠবে।”
আল-বালখী মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলি সন্ধান করেছিলেন কুরআন এবং হাদীস থেকে।
যেমন:
“তাদের অন্তরে একটি রোগ রয়েছে।”
- কোরআন 2:10
” দেহের মধ্যে এমন একটি মাংসপিন্ড রয়েছে তা সুস্থ থাকলে সমস্ত শরীর সুস্থ থাকে আর তা নষ্ট হলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়, আর তা হল অন্তর ।”
- সহীহ আল বুখারী , কিতাব আল-ইমান
“নিশ্চয় আল্লাহ আপনার উপস্থিতি বা ধন-সম্পদকে (মূল্যায়ন করার জন্য) বিবেচনা করেন না তবে তিনি আপনার অন্তর এবং আমলকে বিবেচনা করেন।”
- মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল , নং। 8707
আবু জায়েদ আল-বালখিই ছিলেন স্নায়ুরোগ ও সাইকোসিসের মধ্যে প্রথম পার্থক্যকারী এবং এই শ্রেণিবদ্ধ ব্যাধিগুলির প্রতিটি চিকিৎসার জন্য স্নায়বিক রোগ এবং Cognitive therapy কে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলেন।
তিনি নিউরোসিসকে চারটি আবেগগত ব্যাধি(emotional disorder)তে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন : 1)ভয় বা উদ্বেগ , 2)ক্রোধ বা আগ্রাসন , 3)দুঃখ বা হতাশা, এবং 4)আবেশ ।
পাশাপাশি দুই ধরণের হতাশার ব্যাপারে বলেছেন: 1)এই হতাশা মানুষের মধ্যে থেকে উদ্ভূত হয়,আর সেটা হলো ক্ষতি এবং ব্যর্থতার ভয়,যা অবশ্যই মানসিকভাবে চিকিৎসা করা উচিত ।
2) clinical depression,যা শরীরের বাইরে থেকে উদ্ভূত হয়, যা ব্যথা এবং যন্ত্রণা সৃষ্টি করে,যা সর্বদা অব্যাহত থাকে, এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপ রোধ করে বা জীবন উপভোগ বা আনন্দ উপভোগ করা থেকে বিরত রাখে।যা অবশ্যই ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা উচিত।
তিনি আরও লিখেছেন যে একটি সুস্থ ব্যক্তির সর্বদা তার মনে স্বাস্থ্যকর চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি রাখা উচিত,
সুস্বাস্থ্যের জন্য মন এবং শরীরের মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন এবং এই দুটির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা অসুস্থতার কারণ হতে পারে। আল-বালখীই প্রথম বলেছিলেন পারস্পরিক বাধা(reciprocal inhibition)সম্পর্কে,যা জোসেফ ওলপে এক হাজার বছর পরে 1969 সালে পুনরায় প্রবর্তিত করেন।
মুসলিম চিকিৎসক আবু জায়েদ আল-বালখী ছিলেন সাইকোথেরাপি, সাইকোফিজিওলজি এবং সাইকোসোম্যাটিক মেডিসিনের পথিকৃৎ । তিনি বলেছেন যে শরীর এবং আত্মা সুস্থ বা অসুস্থ, অথবা “সুষম বা ভারসাম্যহীন” হতে পারে এবং বিশ্বাস করা হয় যে আল-বালখিই প্রথম নির্ণয় করেছিলেন যে মানসিক অসুস্থতা মানসিক এবং শারীরবৃত্তীয় কারণপ হতে পারে।তিনি লিখেছেন যে শরীরের ভারসাম্যহীনতার ফলে জ্বর , মাথাব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
তিনি মানসিক ব্যাধিগুলির সাথে শারীরিক ব্যাধিগুলির মধ্যে তুলনাও লিখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে কীভাবে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধিগুলির মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট মিথস্ক্রিয়া হতে পারে।
সারাজীবনে আবু জায়েদ ৬০-এর বেশি বই ও পাণ্ডুলিপি রচনা করেছেন। তবে তার বেশিরভাগই আর পাওয়া যায় না, খুব অল্প সংখ্যক কাজ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।
আল বালখির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম ‘মন ও শরীরের উন্নতিসাধন‘ (মাসালিহ আল-আবদান ওয়া আল আনফুস) । এই পান্ডুলিপিতে আল বালখি প্রথমে শরীরের উন্নতির কথা বলেন, তারপর শরীরের উন্নতি ও অধ্যাত্মবাদের মাধ্যমে কীভাবে মানসিক উন্নতি করা যায় সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ইসলামের ইতিহাসে এই বইটি এক অমূল্য সম্পদ!
নিম্নলিখিত কতগুলো তত্ত্ব আল বালখির এই বইটি থেকে পাওয়া যায়ঃ
১। মানসিক সমস্যা ও তার সঠিক সমাধানঃ
বর্তমান সমাজে মানসিক সমস্যা এখনও বেশ বড়সড় একটি ট্যাবু। এখনও কারোর মানসিক সমস্যা হলে তাকে মানুষ আলাদা না করে দিক, একটু অন্যরকম চোখেই দেখে। সেই জন্যই চিকিৎসাশাস্ত্র এখন মানসিক সমস্যাকে স্বাভাবিক অসুখ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে। মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছে. তাও, সামাজিক ভাবে আমরা এখনও মানসিক সমস্যাকে মেনে নিতে পারি না। আল বালখি কিন্তু বহু বছর আগেই এই নিয়ে লিখে গিয়েছেন। তাঁর মতে, মানসিক সমস্যাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারলেই অসুখের সঙ্গে সহজে লড়াই করা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি সেরে ওঠেন।
২। মন ও শরীরেরর সংযোগঃ
বর্তমানে ডাক্তাররা বলে থাকেন যে সমস্ত অসুখের বীজ লুকিয়ে রয়েছে মনে। আল বালখি বহুদিন আগেই এই কথা বলে গিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ‘যদি মন অসুস্থ হয় তাহলে শরীর সমস্ত স্বাভাবিক কাজ থেকে প্রতিহত হয়। মন ও আত্মায় আঘাত লাগলে শরীরও বিকল হয়ে পড়ে।‘ বলা চলে, তৎকালীন যুগে, সাইকোসোমাটিক অসুস্থতার কথাও তিনি লিখে গিয়েছিলেন।
৩। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারঃ
বর্তমানে এই মানসিক সমস্যার কথা আমরা সকলেই জানি। আল বালখিও এর কথা লিখে গিয়েছিলেন। এমনকী, সাইকাট্রিক ও সাইকোলজিকাল অসুস্থতা হিসাবে বর্তমান চিকিৎসকরা যে যে লক্ষণের কথা বলেন, আল বালখি প্রত্যেকটিই তাঁর বইতে বলে গিয়েছিলেন।
ক্রমাগত নেগেটিভ ভাবনা, উদ্বেগ, হঠাত করে ভয় পাওয়া, যা নয় তাই ভেবে কষ্ট পাওয়া এই প্রত্যেকটি লক্ষণই তাঁর বইতে ভাল করে লেখা রয়েছে।
আল বালখিকে বলা চলে প্রাচীন যুগের প্রথম বিদ্বান যিনি মানসিক সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। লিখে গিয়েছেন তার নানা সমাধান। অাধ্যাত্মবাদ, মনন ও শরীরের সংযোগসাধন করতে চেয়েছেন নিজের লেখার মধ্যে।
এর থেকে বোঝা যায় ইসলামের স্বর্ণযুগ কতটা উন্নত ছিল। আমরা এক উন্নত সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে চলেছি নিজেদের জীবনে।
তিনি ৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।