আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের সব পর্ব:-
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬
[পর্ব ২০] ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আলী ইবনুল-আব্বাস আল-মাজুসী:-ধাত্রীবিদ্যা এবং পেরিনেটোলজি এর অগ্রদূত]
[পর্ব ২১]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[ইবনে তোফায়েল:-প্রথম দার্শনিক উপন্যাস রচয়িতা]
[পর্ব ২৬]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।
[পর্ব ২৮]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল মাহানী]
[পর্ব ২৯]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[ইবনে বাজা]
[পর্ব ৩৩]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল কারাজী]
[পর্ব ৩৪]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[হাবাশ আল-হাসিব আল-মারওয়াজী]
41.উলুঘ বেগ
বৈজ্ঞানিক সম্রাট উলুঘ বেগ ১৩৯৪ খৃস্টাব্দের ২২ মার্চ ইরানের সুলতানিয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তৈমুর লং (১৩৩৬ – ১৪০৫) এর দৌহিত্র হলেন উলুঘ বেগ। তৈমুরের ছেলে এবং উলুঘ বেগের পিতার নাম হলাে শাহরুখ মির্জা এবং তাঁর মা ছিলেন গওহর শাদ নামে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা। তৈমুরের জ্ঞানস্পৃহা বংশানুক্রমিকভবে উলুঘ বেগের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
জ্যোতির্বিদ্যা,ত্রিকোণমিতি (trigonometry) এবং গোলকীয় জ্যামিতিতে (spherical geometry) তার অবদানের জন্য তিনি বিখ্যাত। তিনি মহান মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্টাতা জহির উদ্দীন মোহাম্মদ বাবরের প্রৌপিতামহ।
বাল্যকাল থেকেই উলুঘ বেগ জ্ঞান পিপাসু ছিলেন। কিশাের বয়সেই তিনি কোরআনে হাফেজ হন। এরপর তিনি ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল। বিশেষভাবে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় তিনি বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জনে সক্ষম হন।
তৈমুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শাহরুখ সিংহাসনে আরােহণ করেন। সম্রাট শাহরুখ বিজ্ঞানী না হলেও জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। বিজ্ঞানের চর্চায় ছিলেন। অত্যুৎসাহী।
উলুঘ বেগকে তিনি বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্র ও আর্ট সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষাদান করেন, যুবরাজ উলুঘ বেগ তুর্কিস্তান ও ট্রান্স অক্সিয়ানার শাসনকর্তা থাকাকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় নিমগ্ন থাকেন এবং বিজ্ঞানের নানা শাখায় তিনি সুদক্ষ ছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনায় অন্যান্যদের প্রতি তার উৎসাহ প্রদানেও তিনি পরান্মুখ ছিলেন না।
পিতা শাহরুখের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন। রাজনৈতিক ইতিহাসের মত তার বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসও সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সম্রাট উলুঘ বেগ জ্যোতির্বিজ্ঞান, ত্রিকোনমিতি, জ্যামিতি প্রভৃতিতে সুপণ্ডিত ছিলেন।
পরিণত বয়সে উলুঘ বেগ তুর্কিস্থান ও ট্রান্সঅক্সিয়ানার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সমরকন্দ (বর্তমানে উজবেকিস্তানে) তাঁর রাজধানী। তৈমুর এই সমরকন্দকে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিবিখানম বিশ্ববিদ্যালয় জগদ্বিখ্যাত ছিল। কিন্তু তার সময়ে এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানে তেমন উৎকর্ষতা অর্জন করতে পারিনি। পিতার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন উলুঘ বেগ।
কিশোর শাসক শহরটিকে সাম্রাজ্যের বৌদ্ধিক কেন্দ্র হিসাবে পরিণত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
উলুঘ বেগ সমরকন্দে সুউচ্চ গম্বুজের বহু খানকা ও বহু মসজিদ নির্মাণ করেন এবং তিনি সেখানে অধ্যয়নের জন্য অসংখ্য ইসলামী জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
জ্যোতির্বিদ্যায় উলুঘ বেগের সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন আলী কুশচি ( ১৪৪৪ সালে মারা যান)। কালি জাদা আল-রুমী ওলুগ বেগের মাদ্রাসার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তীতে জ্যোতির্বিদ জামশিদ আল-কাশি কর্মীদের সাথে যোগ দিতে এসেছিলেন।
এখানে তিনি ১৪২০ সালে ইসলামীয় সভ্যতার প্রাচীনতম বিশাল মানমন্দির স্থাপন করেন। এই সকল নির্মাণ কাজে তার গভীর স্থাপত্যবিদ্যা ও শিল্পকলার স্বাক্ষর বর্তমান ছিল।
মানমন্দিরটিতে ছিল একটি বিরাট মধ্যরেখা। মধ্যরেখা বরাবর পাহাড়ে ২ মিটার প্রশস্ত একটি গর্ত খনন করা হয়। টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ করার সুযোগ না থাকায় বেগ ফাখরি সেক্সট্যান্ট নামে পরিচিত তার নিজস্ব যন্ত্র নিয়ে কাজ করতেন। এ সেক্সট্যান্টের ব্যাসার্ধ ছিল ৪০ দশমিক ৪ মিটার। উলুগ বেগের মানমন্দিরের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছিল ভূগর্ভে।
মানমন্দিরটি ১৪৪৯ সালে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং ১৯০৮ সালে খনন কাজ চালিয়ে এ মানমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়।
সমরখন্দে অবস্থিত উলুঘ বেগের মানমন্দির। স্থাপনের সময়ে দেয়ালগুলো মসৃন মার্বেল পাথরে আচ্ছাদিত ছিলো।
এটি অবস্থিত সমরকন্দের শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে চুপান-আতা সমভূমিতে, প্রাচীন আফ্রাসিয়াব শহরের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে।
১৯০৮ সালে রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্লাদিমির ভিয়াৎকিন (Vladimir Viatkin)এই গোলাকার ত্রিতল মানমন্দিরের ভিত এবং মর্মর পাথরের এক বৃহদাকার সেক্সট্যান্টের মাটিতে প্রোথিত অংশ খুঁড়ে বের করেন।
গিয়াস আল-দিন জামশেদ কাশি এবং কাজি-জাদেহ রুমির মত জ্যোতির্বিদেরা এখানে কাজ করেছেন।
এছাড়াও তিনি টলেমির কাজের অনেক ভুল সংশোধন করেন।
উলুগ বেগ এক সৌর বছরের দৈঘ্য পরিমাপ করেছিলেন ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৯ মিনিট ১৫ সেকেন্ড।এই হিসেবে +২৫ সেকেন্ডের ত্রুটি রয়েছে , যা নিকোলাস কোপার্নিকাসের অনুমানের চেয়েও নির্ভুল ছিল,কারণ তার হিসাবে +৩০ সেকেন্ডের ত্রুটি ছিল ।
তিনি সহকর্মীদের নিয়ে রাতের পর রাত জাগ্রত থেকে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের ফল নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন।
তার নাম হলাে জিজ-ই- জাদিদই- মুলতানি। এতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে-১. বিভিন্ন গণনা ও বর্ষ, ২. সময় জ্ঞান, ৩. নক্ষত্রের গতিপথ, ৪. স্থির নক্ষত্রের অবস্থান প্রভৃতি সম্বন্ধে আলােচনা করা হয়েছে।
তালিকাটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সর্বত্রই বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। Ulugh Beg’s Table নামে এখনও তা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
এতে পূর্ববর্তী বৈজ্ঞানিকদের পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন তথ্যফল সহ তাঁদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ফলাফলও বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। এই জিজ তৈরির কাজে সালাউদ্দীন মূসা, মােল্লা আল-কুশজী, গিয়াসউদ্দীন জামশিদ, মইনুদ্দীন কাশানী, কাজীজাদা রুমী প্রমুখ তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক গ্রীভস তালিকাটির প্রতি বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৬৬৫ খৃস্টাব্দে মিঃ হাইড-এর ল্যাটিন অনুবাদ করেন।
১৭৬৭ খৃস্টাব্দে শার্প এই অনুবাদের অন্য একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন। ১৮৪৭-৫৩ খৃস্টাব্দে মিঃ মেডিলাে এর উপক্রমণিকার অনুবাদ প্রকাশ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জয়পুর রাজ্যের মহারাজ জয়সিংহ উলুঘ বেগ প্রণীত নক্ষত্র তালিকার অনুবাদ প্রকাশ করে রীতিমত গবেষণা শুরু করেন।
সম্রাট বৈজ্ঞানিক উলুঘ বেগের তালিকায় শুদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আলােচনার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধেও বিস্তারিত আলােচনা ‘আরবাই চেঙ্গিস চেঙ্গিসের চার পুত্র গ্রন্থ রচনার মধ্যে তাঁর অগাধ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। মিঃ মেডিলাের মতে উলুঘ বেগের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রাচ্যের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাও শেষ হয়ে যায়।
ত্রিকোনমিতি
ত্রিকোনমিতির সাইন, কোসাইন, ট্যানজেন্ট প্রভৃতি পূর্বাবিষ্কৃত ছিল বটে, কিন্তু সবগুলােই ছিল এলােমেলাে-প্রক্ষিপ্ত।
উলুঘ বেগই প্রথম বৈজ্ঞানিকদের সুবিধার জন্য সবগুলাে সংগ্রহ করে তালিকাভুক্ত করেন। এর আগে কোন বৈজ্ঞানিকই তা করেন নি এবং তার Sin,Tan এর বের করা মান আট দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিক ছিল।
এই তালিকায় তাঁর মৌলিক অবদান ছিল প্রচুর। তিনি অনেকগুলাে বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। সেসব মুদ্রিত ও পাণ্ডুলিপি অবস্থায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়।
মৃত্যু
বিজ্ঞানে সাফল্য পেলেও প্রশাসক হিসেবে উলুগ বেগ দক্ষ ছিলেন না। বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন।
শেষে ১৪৪৯ সালে উলুগ বেগের জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্দ আল-লতিফ সাম্রাজ্য দখলের লড়াইয়ে পিতাকে পরাজিত এবং হত্যা করেন। বাবর তার রাজত্বকালে উলুগ বেগের দেহাবশেষ সমরকন্দে তৈমুরের সমাধিস্থলে স্থানান্তরিত করেন।
সম্মান
তার জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজের সম্মানে চাঁদের একটি গর্ত Ulugh Beigh, তার নামে নামকরণ করা হয়।
2439 Ulugbek নামের একটি main belt গ্রহাণুর নামকরণও তার নামে করা হয়।
এছাড়াও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি উলুঘ বেগ কে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ 6 জন জ্যোতির্বিদদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিহ্নিত করেছে এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সেই ৬ জন জ্যোতির্বিদদের বিশাল এক চিত্রকর্ম টাঙানো আছে।