আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের সব পর্ব:-
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৫
ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৬
[পর্ব ২০] ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আলী ইবনুল-আব্বাস আল-মাজুসী:-ধাত্রীবিদ্যা এবং পেরিনেটোলজি এর অগ্রদূত]
[পর্ব ২১]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[ইবনে তোফায়েল:-প্রথম দার্শনিক উপন্যাস রচয়িতা]
[পর্ব ২২]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[আল বালখি:-যিনি সর্বপ্রথম দেহ ও আত্মা সম্পর্কিত রোগসমূহকে সফলভাবে আলোচনা করেছিলেন]
[পর্ব ২৩]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।[ছাবেত ইবনে কোরা:-স্টাটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা]
[পর্ব ২৬]ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।
34.আল মাহানী
আল মাহানী ছিলেন একজন পার্সিয়ান গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ এছাড়াও আরবি ভাষায় বই অনুবাদক হিসেবেও তার খ্যাতি আছে।তিনি ইসলামি সভ্যতার সোনালি যুগের জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
তিনি ৮২০ সালে মাহানে (বর্তমান কের্মান , ইরান ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি বাগদাদের হাউজ অব উইজডম এ সক্রিয় ছিলেন।তার পুরো নাম আবু-আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ঈসা মাহানী।
আল-মাহানীর জীবন সম্পর্কিত খুব সামান্য তথ্য আছে । আমরা ইবনে ইউনূসের জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুস্তিকা আল-জিজ আল-হাকিমি আল-কাবীর থেকে জ্যোতির্বিদ্যায় আল-মাহানির কাজ সম্পর্কে কিছুটা জানি ।
এই রচনায় ইবনে ইউনূস আল-মাহানীর রচনা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, যেগুলি এখন থেকে হারিয়ে গেছে, যা আল-মাহানী 853 থেকে 866 বছরের মধ্যে পর্যবেক্ষণগুলি বর্ণনা করে ।
এ সময় আরব সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপের বিশাল এলাকায়। আর মুসলমানেরা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ।
তিনি ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে ইউক্লিডের ইলিমেন্টস এবং আর্কিমিডিসের গোলক, সিলিন্ডার এবং মেনেলাউসের স্পেরিকা এর উপর গাণিতিক কাজ এবং মন্তব্য পাশাপাশি দুটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার জন্য।
আল-মাহানির উদ্ধৃতি দিয়ে কেবল পরবর্তী লেখকদের রচনার মাধ্যমেই আমরা জানি যে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং পাটিগণিত নিয়ে লিখেছিলেন।
গণিতে তাঁর রচনাগুলি জ্যামিতি, পাটিগণিত এবং বীজগণিত সম্পর্কিত বিষয়গুলি জুড়েছিল। তাঁর কিছু গাণিতিক কাজ সম্ভবত জ্যোতির্বিদ্যায় যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল সেগুলি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। দশম শতাব্দীর ক্যাটালগ Kitab al-Fihrist জ্যোতির্বিদ্যায় নয়, গণিতে আল-মাহানীর অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি তাঁর সময়ে বর্তমান গাণিতিক সমস্যা নিয়েও কাজ করেছিলেন।তিনি গ্রীক গাণিতিক রচনার মন্তব্য লিখেছেন।যেগুলো হলো,ইউক্লিডের ইলিমেন্টস এবং আর্কিমিডিসের গোলক, সিলিন্ডার এবং মেনেলাউসের স্পেরিকা।
আরব অনুবাদক আল-মাহানি সর্বপ্রথম আর্কিমিডিসের গোলক ও স্তম্ভক সম্পর্কিত বইগুলো এবং ইউক্লিডের প্রথম,পঞ্চম,দশম ও দ্বাদশ খন্ড অনুবাদ করেন। যার মধ্যে পঞ্চম ও দশম খন্ডের কিছু অংশ আজও বেঁচে আছে। বইটির পঞ্চম খন্ডে তিনি অনুপাতের ওপর কাজ করেছেন,এবং ধারাবাহিক ভগ্নাংশের উপর ভিত্তি করে অনুপাতের সংজ্ঞা সম্পর্কিত একটি তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন যা পরবর্তীতে আল-নায়রিজী স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন ।
তিনি অযৌক্তিক সংখ্যার(irrational number) উপর কাজ করেছিলেন।তিনি ইউক্লিডের দৈর্ঘ্যের সংজ্ঞাটি প্রসারিত করেছিলেন
তিনি ইউক্লিডের দুর্বোধ্য কর্মগুলো অনুবাদ না করলে তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে যেতো। তিনিই প্রায় লুপ্ত আর্কিমিডিসকে সর্বপ্রথম বিশ্বসভ্যতার উচ্চস্তরে আসন দেন।
তিনি আর্কিমিডিসের স্পেরিকা বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডের কিছু অংশের ভাষ্য লিখেছিলেন , যার কোনোটাই আজ বেঁচে নেই।পরে, নাসির আল-দীন আল-তুসি (১২০১-১২74৪) আল-মাহানী এবং আল-হারাওয়ির সংস্করণকে বাদ দিয়ে আবু নসর মানসুরের রচনার উপর ভিত্তি করে স্পেরিকার নিজস্ব মন্তব্য লিখেছিলেন।আল-তুসির সংস্করণ আরব বিশ্বে স্ফেরিকার সবচেয়ে বহুল পরিচিত সংস্করণে পরিণত হয়েছিল।
আল-মাহানী আর্কিমিদিসের On the Sphere and Cylinder, book II, chapter 4 এ উত্থিত আরও একটি সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন যেখানে প্রদত্ত অনুপাতে দুটি খণ্ডে বৃত্ত ভাগ করতে হবে।
তাঁর কাজ তাকে সমীকরণের দিকে নিয়ে যায়, যা মুসলিম বিশ্বে “আল-মাহানির সমীকরণ” নামে পরিচিত:
X3+c2b=cx2
যদিও তিনি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তী দশম শতাব্দী পর্যন্ত কেউ এই সমস্যা সমাধান করতে পারেনি অবশেষে দশম শতাব্দীর পার্সিয়ান গণিতবিদ আবু জাফর আল-খাজিন কোনিক সেকশন ব্যবহার করে এটি সমাধান করেছিলেন।
গোলক সম্বন্ধে গবেষণামূলক উদ্ভাবনী প্রতিভার জন্য আজো তিনি স্মরণীয় ও বরণীয়। আর্কিমিডিসের প্রবর্তিত ও প্রচলিত গোলক বিষয়ে তিনি গবেষণা করেন। আধুনিক গোলকে যেসব সূত্র ব্যবহার করা হয়, সেসব সূত্রের তিনিই উদ্ভাবক। আর তাই আল-মাহানিকে আধুনিক গোলকের আবিষ্কারক হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর্কিমিডিসের গোলক বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি যেসব প্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করেন, তা এখনো প্রচলিত।
আর্কিমিডিস আয়তনের কোনো নির্দিষ্ট অনুপাত অনুসারে গোলককে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত করার পন্থা নির্দেশ করেন। একে ভিত্তি করে আল-মাহানিও গোলককে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং এ বিষয়ে বেশ কিছু নতুন পন্থাও আবিষ্কার করেন। আল-মাহানির আবিষ্কৃত পন্থাগুলো আজো অঙ্কশাস্ত্রে বিশেষ স্থান অধিকার করে। গোলক সম্পর্কিত গবেষণামূলক উদ্ভাবনী প্রতিভাই তার জন্য বিজ্ঞান জগতে স্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট। তবে এর বাইরেও তার অবদান আছে। তিনি অঙ্কশাস্ত্রে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে ত্রৈমাত্রিক সমীকরণের সম্পাদ্যে ত্রিকোণমিতির সাহায্য নেন, যা সেই সময়ের অঙ্কবিদদের কল্পনার বাইরে। তার মানে তিনি এর পথপ্রদর্শক।
গোলকবিষয়ক আলোচনায় যে বীজগাণিতিক সমীকরণের উদ্ভব হয়, তার সমাধানে আল-মাহানি ত্রৈমাত্রিক কোণের চিহ্ন ব্যবহার করেন। ত্রিকোণমিতির ব্যবহার তার অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেয়। কারণ সেই যুগে ত্রিকোণমিতির ব্যবহার ছিল সবার ভাবনার বাইরে।
আল মাহানী গণিতের ওপর পৃথক দুটি গ্রন্থ লিখেছিলেন একটি হলো:-Fi al-Nisba (“On Relationship”) এবং আরেকটি হলো:- squaring of parabola.
জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো আজিমুথের গণনা।তিনি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ করতেও পরিচিত ছিলেন।
ইবনে ইউনূস আল-মাহানীর বরাত দিয়ে বলেছেন যে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহায্যে তাদের সময় গণনা করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে পর পর তিনটি চন্দ্রগ্রহণের সূচনা সময় তার অনুমানের অর্ধ ঘন্টার মধ্যে সঠিক ছিল।
তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণ সংশ্লেষ (conjunctions) সম্পর্কে পাশাপাশি সৌর এবং চন্দ্রগ্রহণ ইবনে ইউনূসের জিজ (জ্যোতির্বিদ্যার টেবিল) এ উদ্ধৃত করা হয়েছিল।
তিনি জ্যোতির্বিদ্যার ওপর একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।বইটির নাম Maqala fi ma’rifat as-samt li-aiy sa’a aradta wa fi aiy maudi aradta (“On the Determination of the Azimuth for an Arbitrary Time and an Arbitrary Place”)জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর বেঁচে থাকা এটি একমাত্র কাজ।
তিনি আর একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার শিরোনাম On the Latitude of the Stars তবে এটি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে।
পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিদ ইব্রাহিম ইবনে সিনান (908-946) এর মতে আল-মাহানী একটি সৌরঘড়ি ব্যবহার করে ascendant পরিমাপ করার জন্য একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন
তিনি ৮৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।এখনো আল-মাহানি স্মরণীয় ও বরণীয়।